মন থেকে শরীরে ::: সুশান্ত পাল
ইনবক্সের একান্ত ব্যক্তিগত কিছু কথাকে সংলাপে লিখলে মোটামুটি এমন দাঁড়ায়:
ভাইয়া, একটা বাজে ছেলে দিনের পর দিন আমার সাথে প্রতারণা করেছে।
মানে?
প্রেমের অভিনয় করে আমাকে ক্রমাগত ভোগ করে গেছে।
আচ্ছা। এখন কি সম্পর্ক নেই?
না ভাইয়া, ও একটা ভণ্ড প্রতারক। আমি ওর বিরুদ্ধে মামলা করতে চাই।
করতে পারো, তবে মামলাতে তুমি হেরে যাবে।
কেন?
ও কি তোমাকে রেইপ করেছে?
না, কিন্তু ওর সবটাই ছিল ছলনা। ও আমাকে যা বলত, যা দেখাত, সবই ছিল মিথ্যা।
ওসব তোমার আবেগের কথা।
আবেগ না ভাইয়া, এটাই সত্য।
জোর করে তো কিছু করেনি। করেছে?
না।
তার মানে, সম্পূর্ণ স্বেচ্ছায় তুমি ব্যাপারটা মেনে নিয়েছ অনেকদিন ধরে। তোমার সম্মতি ছিল। ইট ওয়াজ সামথিং মিউচ্যুয়াল। রাইট?
কিন্তু, আমি প্রতিশোধ নিতে চাই। এতকিছুর পর, ও আমাকে এভাবে ছেড়ে যেতে পারে না।
প্রতিশোধ নেয়ার তো কিছু দেখছি না। যে তোমার সাথে থাকতে চায় না, তাকে জোর করে ধরে রাখার কিছু নেই। বরং, ঈশ্বরকে ধন্যবাদ দাও যে, একজন ভুল মানুষের সাথে সারাজীবন কাটাতে হচ্ছে না।
আপনি আমার আবেগের জায়গাটা বুঝতে পারছেন না, ভাইয়া।
বুঝলে কী হবে? কী করার আছে এখন?
আমি যেকোনো মূল্যে এর প্রতিশোধ নেবো। আমার তো কোনো দোষ ছিল না।
আচ্ছা ঠিক আছে, তুমিও একটা নিষ্পাপ নির্দোষ ছেলেকে দিনের পর দিন ভোগ করে একদিন ওর সাথে প্রতারণা কর, ওকে ছেড়ে দাও। ব্যস্ বদলা নেয়া হয়ে গেলো!
ছিঃ! আপনার সাথে কথা বলার রুচি হচ্ছে না আমার! কী বলছেন আপনি? এসব পাপ, ভাইয়া!
আনন্দ করার সময় এটা মাথায় আসেনি?
এভাবে বলবেন না, ভাইয়া। আমি ওকে ভালোবাসতাম। যা করেছি, ভালোবেসেই করেছি।
যাকে ভালোবাসতে, তার সম্পর্কে এরকম আজেবাজে কথা বলছই বা কেন?
ও একটা ফালতু ছেলে, ভাইয়া। হি ডিজার্ভস্ দিস্!
তাহলে তো খুব ভাল হলো, বেঁচে গেলে! এবার একটা পার্টি দাও!
আপনি আমাকে কথা শোনাচ্ছেন। আর ও যে এতকিছু করল, সেটা কিছু না?
ওর কথা ছাড়ো। ও তো ভালোই বাসত না, ও যা ইচ্ছে, করতেই পারে। ও চেয়েছিল, কৌশলে তোমাকে ফাঁদে ফেলতে, এবং ও সেটা করতে পেরেছে। হি ইজ সাকসেস্ফুল! তুমিই বল, ও ওরকম ভালোবাসে-টাসে না বললে, সেক্স করতে দিতে?
আপনি আসলেই ব্যাপারটা বুঝতে পারছেন না, শুধু শুধু আমাকে দোষ দিচ্ছেন। ও আমাকে বলেছিল, সেক্স না করলে রিলেশন রাখবে না।
আর অমনিই তুমি ঝাঁপিয়ে পড়লে? এতোই সস্তা?
আমি যে ওকে যেকোনো কিছুর বিনিময়ে সারাজীবনের জন্য চেয়েছিলাম!
কিছু মুহূর্তের শারীরিক সম্ভোগ সারাজীবনের বিনিময়-মূল্য হতে পারে না। সারাজীবন তো অনেক বড় জিনিস, সেক্স নিতান্তই তুচ্ছ একটা ব্যাপার! এইটুকু বুঝতে হলে রকেট-সায়েন্টিস্ট হতে হয় না। ভালোবাসায় শরীর আসতেই পারে---তবে সেটা স্বাভাবিকভাবে, শর্তের চাপে পড়ে নয়। আর এতো কথা বলার কী আছে?---করেছো, করেছো! এটা নিয়ে এতো হৈচৈ করার কিছু দেখি না। এখন ওর উদ্দেশ্য বুঝতে পেরেছো, ওর কাছ থেকে সরে এসেছো, কিংবা ও নিজেই সরে গিয়ে তোমাকে বাঁচিয়ে দিয়েছে।
ও একটা লম্পট। আমি ওকে প্রচণ্ড বিশ্বাস করতাম, আর ও আমার সরলতার সুযোগ নিয়েছে। ও আমাকে রেইপ করেছে।
ওকে প্রচণ্ড বিশ্বাস করতে---কে বলেছিল করতে? তোমার বিচার, বোধ-শক্তি নেই? ব্রেকাপের আগে যেটা ছিল ‘লাভমেকিং’, ব্রেকাপের পর সেটা হয়ে গেলো ‘রেইপ’? বাব্বাহ্! এই তোমার সততা? পারো বটে! বাদ দাও ওসব! তোমার কথা ধরেই বলি, একটু ভেবে দেখো তো, ভালোই তো হলো, একটা লম্পটের কাছ থেকে মুক্তি পেয়েছো। এটা নিয়ে যতো তাড়াতাড়ি মাথাখারাপ করা বন্ধ করবে, ততোই মঙ্গল।
আপনি যা-ই বলুন না কেন, আমি ওকে কিছুতেই ছাড়ব না।
তোমার মাথা কাজ করছে না। আচ্ছা, ঠিক আছে, ছেড়ো না। জীবনের আরও কিছু সুন্দর সময়কে নরক বানাও। ইয়োর লাইফ, ইয়োর চয়েজ!
তার মানে, আপনি আমাকে হেল্প করবেন না?
তোমাকে হেল্প করতে আমি বাধ্য নই। যা বলছি, তা-ই তো বেশি! এসব ব্যাপারে এর চাইতে বেশি হেল্প করার কিছু নেই। এমনকি, তুমি যদি আমার প্রেমিকাও হতে, আমি আমার প্রেমিকার কোনো একসময়ের শয্যাসঙ্গীকে ধরে এনে ঠ্যাঙাতে পারি না। ইটস্ নট রেশনাল। ইটস্ নট ফেয়ার।
আমি সেটা বলছি না, আমাকে কিছু পরামর্শ তো দিতে পারেন।
একটাই পরামর্শ---সামনের দিকে তাকিয়ে বাঁচো, সামনের দিকে তাকিয়ে বাঁচার প্র্যাকটিস্ কর। সিম্পল্!
লাইফ থেকে একটা চ্যাপ্টার পুরোপুরি ডিলিট করে ফেলা যায় না---ওটা বড় কষ্ট দেয়।
সে চ্যাপ্টারকে লাইফের অনুষঙ্গ করে বেঁচে থাকলে যে সেটা লাইফকে একেবারে শেষ করে দেয়---এটা মাথায় আসে না?
এই জাতীয় চিঠি অনেক আসে। প্রায় সবাইই, খুবই আবেগপূর্ণ বিক্ষত হৃদয়ে আমাকে চিঠি লিখে, রেডিমেড সল্যুশন চায়। আসলেই কি এর কোনো সল্যুশন আছে আদৌ? সান্ত্বনা দেয়া যায়, ওকে সময় দেয়া যায়, ওর হৃদয় শান্ত করে দেয়া যায়, কিন্তু বলে দেয়া যায় না---এই এই কর, সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে। মানুষ যখন এ ধরনের কোনো সমস্যায় পড়ে, তখন সে এটা ভাবতে পছন্দ করে যে, কেউ না কেউ আছে, যে কিনা তার সমস্যার সব সমাধান জানে। দুজন মানুষ পারস্পরিক সম্মতিতে ভালোবাসার নামে/ দাবিতে সেক্স করছে। আমি এমনও দেখছি, শুধু সেক্সটাকে জায়েজ করার জন্য অনেক প্রেমিক-প্রেমিকা বিয়ে করে, এরপর মনের আর শরীরের দাবি মেটায়। এতে দোষ বা গুণ কি কারো একার? আমার তো মাথায়ই আসে না, স্রেফ সেক্স করতে হলে ভালোই বা বাসতে হবে কেন? ভালোবাসা ব্যাপারটাকে আমি অনেক বড় কিছু বলেই বুঝি---যেকোনো বিশ্বাস, প্রথা বা রীতির চাইতেও বড়, সেখানে বিয়ে খুবই তুচ্ছ একটা জিনিস। খুব হিসেবি কারো পক্ষে প্রেমে পড়া সম্ভব না, কিংবা প্রেমে পড়ে হিসেবি থেকে যাওয়া সম্ভব না। প্রেমে পড়লে মানুষ ছাগল হয়ে যায়। এরপর শুরু হয় ছাগলামি। সে ছাগলামির আনন্দও তো কম নয়! কে তা অস্বীকার করতে পারে? তবে কেন ব্রেকাপের পর সেটাকে প্রতারণা নামে ডাকা হবে? ভালোবাসাটা প্রতারণা হতে পারে---একজন ভালোবেসেছে, আরেকজন অভিনয় করেছে। প্রেমটা প্রতারণা হতে পারে---একজন প্রেম করেছে, আরেকজন টাইমপাস করেছে। কিন্তু, সেক্সটা তো উভয়েই করেছে---সেটার দায়ভার কেন শুধু একজনই নেবে? ইন্দ্রিয়সুখের ভাগ কি কারো একার ছিল নাকি? সেক্স যদি পাপই হয়, তবে সবসময়ই পাপ---ব্রেকাপের আগে বা পরে। সেক্স যদি পুণ্যই হয়, তবে সবসময়ই পুণ্য---ব্রেকাপের আগে বা পরে। হোক পাপ, হোক পুণ্য---তার ভাগ দুজনেরই সমান সমান। ভালোবাসার মোহ অন্ধ---মানছি। মোহ কেটে গেলেও মোহ নিয়ে বেঁচে থাকায় কী সুখ? কেন অন্ধত্ব সেরে ওঠার পরও অন্ধত্বের সময়কার কষ্টগুলিকে সাথে নিয়ে পথ চলতে হবে? অন্ধ মানুষ যখন দেখতে শুরু করে, তখন সে সামনের দিকেই তাকায়, পেছনের দিকে নয়। যে পেছনের দিকে তাকায়, তাকাতে চায়, তার অন্ধত্ব আসলে সারেইনি। অন্ধ অবস্থায় মানুষ হোঁচট খায়, ভুল পথে চলে। সেটাই তো স্বাভাবিক। তা নিয়ে অতো দুঃখ পাওয়ার কী আছে? জীবনের সার্থকতা বা নিরর্থকতা---এর কোনোটাই অন্ধ থাকার দিনগুলি ঠিক করে দেয় না, বরং অন্ধ থাকার দিনগুলি শেষ হয়ে যাওয়ার পরের দিনগুলিতে কত বেশি বা কম পুরনো দিনগুলি ভুলে বাঁচা যায়---সে মানসিক শক্তিই ঠিক করে দেয়।
ভুল মানুষকে আপনার দামি আবেগগুলি দেখানো বন্ধ করুন---দেরি হয়ে যাওয়ার আগেই---এখনই! আপনার আবেগগুলিকে সস্তা হয়ে যেতে দেবেন না---প্রাণ গেলেও না! একটু খেয়াল করলে দেখবেন, ভুল মানুষকেই আবেগ দেখাতে ইচ্ছে করে সবচাইতে বেশি। সঠিক মানুষটিকে, ধাক্কা খাওয়ার আগ পর্যন্ত আমরা দাম দিতে জানি না। মানুষ হিসেবেই বেড়ে উঠছিলেন, হঠাৎ, ভুল মানুষের প্রেমে পড়ে গেলেন, আর অমনিই মানুষ থেকে খেলনায় পরিণত হলেন। আপনার প্রশ্রয় ছাড়া আপনাকে নিয়ে খেলা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। কারো সাথে মেশার সময়ই নিশ্চিত হয়ে নিন, উনি আপনাকে আসলে কী ভাবেন---খেলনা? নাকি, রক্ত-মাংস-অনুভূতিতে গড়া মানুষ? ওইটুকু বুঝতে পারার আগেই মেশামেশি শুরু করে দেবেন না, একটু সময় নিন। প্রেম তো আর পালিয়ে যাচ্ছে না---যে প্রেম পালিয়ে যায়, সেটা নিশ্চিতভাবেই আপনার জন্য ছিল না। প্রেম জোর করে ধরে রাখার জিনিস নয়। যদি কেউ আপনাকে, আপনার অনুভূতিকে নিয়ে খেলা করে, এর জন্য আপনিই দায়ী---আপনি নিজেই আপনাকে ওর খেলনা বানিয়ে ফেলেছেন। এরকম করতে করতে মানুষ একটাসময়ে ওটাতেই অভ্যস্ত হয়ে পড়ে---তখন, নিজেকে খেলনা রূপেই দেখলেই বরং স্বাভাবিক মানুষ মনে হয়। অবশ্য, ওরকম কিছু হয়ে যাওয়াতে যদি আপনার আনন্দ হয়, আপত্তি না থাকে, তবে, ঠিক আছে। সব প্রেমই মন থেকে শরীরে যায় না, কিছু কিছু প্রেম শরীর থেকেও মনে যায়। পূর্ণ সম্মতিতে, মানসিক বা শারীরিক সংস্পর্শের ব্যাপারে কারো কিছু বলার থাকে না। যদি তা না হয়, তবে আপনার ভালোবাসা হবে প্রেমিকের, প্রেমিকার---ক্রীতদাসের নয়। কী ছেলে, কী মেয়ে---ক্রীতদাসের ভালোবাসা যে পায়, সে নিজেকে প্রভু ভাবতে শুরু করে। এটাই স্বাভাবিক।
ভালোবাসার সমাপ্তি বিয়েতেই, কিংবা বিয়ে হয়ে গেলেই ভালোবাসা দুজনের মধ্যেই বাঁধা পড়ে যায়, কিংবা ভালোবাসলে কাছে পেতেই হবে---খুব ভুল কথা। ভালোবাসা অনন্ত, এর সমাপ্তি হয় না, প্রেমের সমাপ্তি হতে পারে। তবে, ভালোবাসা যেন এমন বিশ্বাসের ভিত্তিতে হয়, যেটা প্রেম শেষ হয়ে যাওয়ার পরও ঘৃণার জন্ম না দেয়। যে ভালোবাসা ঘৃণায় শেষ হয়, সেটা কোনোভাবেই ভালোবাসা ছিল না---বড়োজোর মোহ হতে পারে। সত্যিকারের ভালোবাসাও, কখনোসখনো ঘৃণার জন্ম দিতে পারে, তবে সে ঘৃণা সাময়িক, চিরন্তন নয়---একসময়, ঘৃণার নিষ্ঠুর পর্দা সরে গিয়ে ভালোবাসাই শেষ পর্যন্ত টিকে যায়। ভালোবাসা যতটা অপ্রতিরোধ্য, ভালোবাসা-সঞ্জাত ঘৃণা ততোধিক অপ্রতিরোধ্য---তাই, সে ঘৃণার আয়ু ভালোবাসার আয়ুর চাইতে কম। ভালোবাসায় আনন্দ থাকবে, সুখ থাকবে। পারস্পরিক সম্মানবোধ থাকবে, সহমর্মিতা থাকবে। যদি সেসব কিছু না থাকে, তবে সেটা ভালোবাসা নয়---বড়োজোর, চুক্তিভিত্তিক মানসিক বা শারীরিক বা উভয় প্রকারের প্রেম। হ্যাঁ, সেখানে যেকোনো একজনের সত্যিকারের ভালোবাসা হয়তো থাকে, বা কোনোভাবে জন্মে যায়---সেটা নিশ্চয়ই স্বর্গীয়। প্রায়সময়ই, সে বুঝতেই পারে না, যেটাকে সে ভালোবাসা ভাবছে, ওর ভালোবাসার মানুষটির কাছে সেটা নিছকই, সুন্দর কিছু মুহূর্তযাপন বা অভ্যস্ততা। যখন সে এটা বুঝতে পারে, তখন অসীম আফসোস বা ক্রোধ জন্মাতেই পারে, তবে, সে আকস্মিক অনুভূতির তীব্রতায় নিজেকে তিলে-তিলে শেষ করে দেয়ার তো কোনোই মানে হয় না। প্রকৃত ভালোবাসা মানুষকে আনন্দ দেয়, মহান করে। যে ভালোবাসতেই পারল না, অথচ ভালোবাসার অভিনয় করে গেছে, সে আসলে কিছুই পায় না---না মনের আনন্দ, না মনের সুখ, না মনের তৃপ্তি। শরীরের দাবি নিয়ে মানুষ কতক্ষণ কাটায়? মনের দাবিটাই তো সারাজীবন ধরে সাথে থেকে যায়। তবে, জিতল কে? নিপুণ অভিনয়? নাকি, আন্তরিক ভালোবাসা? প্রেমহীন শারীরিক বা মানসিক সম্মত-স্পর্শ, আর ব্যভিচারের মধ্যে একটাই পার্থক্য---প্রথমটি কপট, দ্বিতীয়টি অকপট।
No comments