দ্য বস ইজ অলওয়েজ রাইট (রিটার্নস)::আনিসুল হক
অফিসের সভাকক্ষে বসে খেলা দেখছি। খেলা হচ্ছে বাংলাদেশ বনাম সাউথ আফ্রিকা। টেলিভিশনের পর্দায় লেখা, বিএএন ভার্সাস এসএ। বস ঢুকলেন। বললেন, কী দেখছেন? খেলা? বাংলাদেশের সঙ্গে কে খেলছে? সাউথ আমেরিকা? আমরা সবাই বললাম, জি স্যার।
এইটাই আমাদের অফিসের শিক্ষা।
আমাদের প্রত্যেকের টেবিলের সামনে ডিসপ্লে বোর্ডে লেখা আছে—
রুল ১: দ্য বস ইজ অলওয়েজ রাইট
রুল ২: ইফ বস রং, সি রুল নম্বর ওয়ান।
বস এসএ-কে সাউথ আমেরিকা ভেবেছেন। আসলে, সবাই জানে, এটা সাউথ আফ্রিকা। বাংলাদেশ সফরে এসেছে দক্ষিণ আফ্রিকা। বাংলাদেশ ওয়ানডেতে তাদের সঙ্গে একটা খেলায় জিতেছেও। সারা বাংলাদেশ উত্তেজনায় কাঁপছে। আর বস ভাবছেন এসএ মানে সাউথ আমেরিকা। সাউথ আমেরিকা কোনো দেশ নয়।
কিন্তু বস তো কখনো ভুল করতে পারেন না।
আর বস যদি ভুল করেনও, আমাদের দেখতে হবে রুল নম্বর ওয়ান, বস কখনো ভুল করতে পারেন না।
আমাদের এইটা একটা ইঞ্জিনিয়ারিং প্রতিষ্ঠান। আমরা সবাই তরুণ প্রকৌশলী। আমাদের বস বাংলায় এমএ। তিনি আমাদের এই অফিসের ম্যানেজার কাম সিইও। তিনি আমাদের যা বলেন, আমরা তা-ই শুনি।
আমরা জি স্যার জি স্যার করি।
বস দেখতে সুদর্শন। আমাদের অ্যাকাউন্ট অফিসার নীলা বলে, সুন্দর গাধা। বস ধবধবে ফরসা, ছয় ফুট লম্বা। চেহারার মধ্যে একটা ঋষি কাপুর ঋষি কাপুর ভাব আছে। ঋষি কাপুর মনে হয় লম্বা না, কিন্তু আমাদের বস লম্বা।
লম্বা, ফরসা, ঋষি কাপুর-মার্কা লোকটার খবিশ হওয়ার কোনো কারণ ছিল না। লম্বা মানুষের বুদ্ধি নাকি থাকে হাঁটুতে। কিন্তু আমাদের বসের বুদ্ধি নেমে এসেছে পায়ের নখে। যেদিন তিনি পায়ের নখ কেটে ফেলেন, সেদিন তাঁর শরীরে এক ফোঁটাও ব্রেন থাকে না বলে আমাদের সবার দৃঢ় বিশ্বাস।
সেদিন তিনি চিঠি লিখেছেন, আই অ্যাম গো টু থাইল্যান্ড।
আমাকে ডেকেছেন। আমি রুয়েট থেকে পাস করা সিভিল ইঞ্জিনিয়ার। আমার ২৮ বছরের জীবনে এই রকমের ইংরেজি দেখি নাই। আই অ্যাম গো। আমি বললাম, স্যার, এটা গোয়িং হবে।
স্যার বললেন, তুমি বেশি জানো না আমি বেশি জানি?
আমি বললাম, আপনি বেশি জানেন স্যার।
আমি বেশি জানি না কম্পিউটার বেশি জানে?
আপনি বেশি জানেন স্যার।
তিনি বললেন, না, কম্পিউটার বেশি জানে। আমি কম্পিউটারে স্পেলচেকার দিয়েছি। কম্পিউটার বলেছে, এই ইংরেজি ঠিক আছে। কাজেই ‘আই অ্যাম গো হবে’। বুঝেছ?
আমি বললাম, জি স্যার। অবশ্যই ‘আই অ্যাম গো’ হবে।
কিন্তু এর পরের বাক্যটা লিখেছেন ভয়াবহ।
আই উইল শিট ইন মাই অফিস অন সেপ্টেম্বর ১২। শিট বানান এস এইচ দিয়ে লেখা। সর্বনাশ।
আমি বললাম, স্যার, বানানটা বোধ হয় ভুল হয়েছে। এটা হবে এস আই টি।
না না, আমি স্পেলচেকার দিয়ে চেক করিয়েছি। ঠিক আছে।
স্যার এই চিঠি আমাদের হেড অফিসে পাঠালেন।
হেড অফিস থেকে আমাদের এমডি ফোন করলেন।
আমি তখন তাঁর রুমে ছিলাম। কী আলাপ হলো, সেটা অনুমান করতে পারি।
আপনার চিঠিটা খুব সুন্দর হয়েছে।
থ্যাংক ইউ স্যার।
আপনি আই অ্যাম গো লিখেছেন।
জি স্যার।
খুব ভালো ইংলিশ। আচ্ছা, আই উইল শিট, আপনি যে বানান লিখেছেন, সেটার মানে জানেন?
মানে স্যার ভুল হয়েছে নাকি? আমি অবশ্য বলেছিলাম ভুল হয়েছে। কিন্তু রফিকুল গাধাটা বলল স্পেলচেকার দিয়ে চেক করেছে।
রফিকুল কে? তাঁকে আজকেই অফিস থেকে বের করে দিন। আর আপনার শিট শব্দটা গুগল করে মানে দেখে নিন।
ওকে স্যার। এখনই দেখছি স্যার।
তিনি ফোন রাখলেন। বললেন, রফিকুল, একটা চিঠি ঠিকভাবে লিখতে পারো না?
আমি হাত কচলাতে কচলাতে বললাম, স্যার, কিছু কি হয়েছে স্যার?
ভুল ইংরেজি লেখো আবার বলো স্পেলচেকারে চেক করিয়েছি। তোমার চাকরি নট।
আমি বললাম, ইয়েস স্যার।
এই শোনো, ‘শিট’ একটু গুগল করো তো।
আমি পারব না স্যার।
তুমি জানো, বস ইজ অলওয়েজ রাইট। করো গুগল।
আমি গুগল করলাম। তাঁকে দেখালাম। তিনি চেয়ারে শরীর এলিয়ে দিলেন।
ঘামছেন। টাইয়ের নট খুললেন। আমি রিমোট তুলে এসির ঠান্ডা বাড়িয়ে দিলাম।
একটু পরে বললেন, রফিক। তোমার চাকরি নট। এমডি স্যারের অর্ডার।
আমি বললাম, ইয়েস স্যার।
তিনি ঘামছেন। আমি টিসু্য পেপার এগিয়ে দিলাম।
তিনি বললেন, ঠোঁটটা চটচট করছে। ওই চ্যাপস্টিকটা দাও তো।
চ্যাপস্টিক হলো ঠোঁটে দেওয়ার বাম। লিপস্টিকের মতোই। একটা ছোট্ট আঙুলের মতো জিনিস। লিপস্টিকের মতোই ঘোরাতে হয়। তারপর লিপস্টিকের মতোই ঠোঁটে ঘষতে হয়। পেট্রোলিয়াম জেলি বা ভ্যাসলিন-জাতীয় জিনিস থাকে। এটা ঘষলে ঠোঁট ফাটে না।
আমি দেখলাম, স্যার যেটাকে দেখিয়ে দিচ্ছেন সেটা চ্যাপস্টিকও না, লিপস্টিকও না। সেটা আসলে গ্লু স্টিক। আঠার স্টিক। এটা কাগজে ঘষে তার ওপর আরেকটা কাগজ দিলে আটকে যায়। নতুন এসেছে এই অফিসে। আমাদের অফিস সুপারভাইজার এটা নতুন কিনে এনেছেন।
খুবই ভালো আঠা। ফেবিকল কোম্পানির। দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কাজ হয়। হাতির পায়ের নিচে এই গ্লু লাগালে হাতিও নড়তে পারবে না।
আমি স্যারকে গ্লু স্টিক এগিয়ে দিলাম।
তিনি সেটা তাঁর ঠোঁটে ঘষতে লাগলেন।
আমি স্যারের রুমের বাইরে এলাম। সবাইকে ডাকলাম।
আসো আসো, স্যার ঠোঁটে সুপার গ্লু লাগিয়েছেন।
কে কে তামাশা দেখবে আসো।
কেউ রুমে ঢুকতে সাহস পেল না। কিন্তু কাচের দরজার নিচের দিক দিয়ে সবটা দেখা যায়।
ওরা সবাই রুমের দরজার কাছে বসে ভেতরের তামাশা দেখতে লাগল।
স্যারের দুই ঠোঁট আটকে গেছে।
তিনি কথা বলতে পারছেন না।
আমি বললাম, স্যার, চ্যাপস্টিকটা কেমন?
স্যার অসহায়ের মতো করে তাকাচ্ছেন।
আমি বললাম, স্যার, আমি জানতাম, এটা ঠোঁটের ক্রিম না। এটা সুপার গ্লুর স্টিক। কিন্তু আপনাকে বলি নাই। বলি নাই, কারণ এই অফিসের নিয়ম হলো, বস ইজ অলওয়েজ রাইট। আর বস যদি ভুলও করে, তখনো এক নম্বর নিয়মটাই দেখতে হয়। এক নম্বর নিয়মটা হলো, বস ইজ অলওয়েজ রাইট।
বস রেগে গেলেন। রেগে গিয়ে হাতের কাছের মোবাইলটা তুলে আমার মাথা বরাবর মারলেন।
আমি মাথাটা সরিয়ে ফেললাম।
বললাম, আপনাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে হবে। আপনি কি আমার সঙ্গে যাবেন?
তিনি একটা পেপার ওয়েট তুলেছেন।
এরপর আর রুমে থাকা নিরাপদ নয়। আমি দরজা খুলে দৌড়াতে যাব, দেখি, সামনে সাত-আটজন নারী-পুরুষ বসে আছে। তারা হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ছে।
এদের ডিঙিয়ে আমি এখন যাই কীভাবে।
স্যার বোধ হয় আমাকে হারামজাদা বলে গালি দিতে গিয়েছিলেন। ঠোঁটে টান পড়ল। মুখ থেকে কথা বের হলো না। হাতের পেপারওয়েট টেবিলে পড়ল। টেবিলের কাচ গেল ভেঙে।
আমি উপবিষ্ট সহকর্মীদের ফাঁকফোকর গলে অফিসের বাইরে চলে এলাম।
বাইরে খুব সুন্দর বাতাস বইছে। আকাশটা মেঘমুক্ত। নীল। একটা কাক ইলেকট্রিকের তার থেকে আকাশের দিকে ছুটল।
একটা কাকও কত স্বাধীন। ইশ্, আমি যদি ওই কাকটাও হতে পারতাম!
No comments