জীবনকে সুন্দর করতে পাঁচটি উপদেশ

জীবনকে সুন্দর করতে পাঁচটি উপদেশ:
( সঙ্গীত-বিস্ময় এ আর রহমান এর বক্তব্য থেকে অনুবাদ করেছেন অঞ্জলি সরকার)

প্রথমত, ভ্রমণ থেকে শিক্ষা লাভ করা। মনকে সবসময় নতুন কিছু গ্রহণ করার জন্য তৈরি রাখতে হবে। পথ চলতে চলতে যাই পাওয়া যায়, তাকে উদার চোখে দেখতে হবে, গ্রহণ করতে হবে। আমরা প্রায় সময়ই অন্যের মতামতের ওপর ভিত্তি করে চলি। কোথাও যাওয়ার আগেই তার সবকিছু নিয়ে আমাদের কমবেশি একটা ধারণা তৈরি হয়ে যায়। কিন্তু আমাদের এটা বুঝতে হবে যে প্রতিটি মানুষেরই নিজস্ব বৈশিষ্ট্য, চিন্তাচেতনা ও স্বাতন্ত্র্য রয়েছে। কোনো একটা স্থানের অনেক অন্তর্নিহিত রহস্য থাকে, যা আমরা সশরীরে, স্বচক্ষে, খোলা মনে পর্যবেক্ষণ না করলে কখনও ধরা দেয় না। এই সত্যগুলোকে জানতে হলে নিজের বাস্তব অভিজ্ঞতার কোন বিকল্প নেই।

দ্বিতীয়ত, কখনও তড়িঘড়ি করে সিদ্ধান্তে উপনীত না হওয়া। এই ব্যাপারটি বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ যখন আমরা কোনো মানুষের বেলায় চিন্তা করি। সব গল্পের পেছনেই একটি ভিন্ন গল্প থাকে, যেমন একটি কয়েনের এপিঠ আর ওপিঠ সম্পূর্ণ ভিন্ন হতেই পারে। মানুষের বেলায়ও ঠিক তাই। আমাদের সবসময় মানুষের অন্তর্নিহিত সৌন্দর্যকে খুঁজে দেখতে হবে এবং তার যথাযথ মূল্যায়ন করতে হবে। এমনকি কোনো স্থান, প্রতিষ্ঠান কিংবা শিল্পকলার ব্যাপারেও এই নীতিটি প্রযোজ্য। আমরা যদি বাইরের দৃশ্যমান রূপটাকেই চূড়ান্ত বলে ধরে না নিয়ে একটু গভীরভাবে মনের চোখ দিয়ে দেখতে শিখি, একটু ধীরস্থির ভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি, তাহলে আমার বিশ্বাস আমাদের অর্ধেক সমস্যারই কোনো অস্তিত্ব থাকবে না।
তৃতীয়ত, যখন জীবনে কোনো সংকটময় মুহূর্ত আসবে, তখন মনকে শান্ত করে ফেলতে হবে, গতি কমিয়ে আনতে হবে। সংকট সমাধানে যে পদক্ষেপই নাও না কেন, তা দৃঢ়তার সাথে পালন করতে হবে। স্থিরতা ও দৃঢ়তা- এ দুয়ের সমন্বয় তোমাকে একদিন না একদিন সংকট থেকে উদ্ধার করে অভাবনীয় কিছু উপহার দেবেই। কিন্তু শুধু একটা কথা মনে রাখবে, কখনও রাতারাতি কোনো পরিবর্তন আশা করো না। তোমার পুরস্কার ঠিক সময়েই তোমার হাতে পৌঁছাবে। যদি উপযুক্ত সময়ের আগেই তুমি তোমার সব কাজের মূল্যায়ন পেয়ে যাও, তাহলে সেই মূল্যায়ন আর পুরস্কার একটা সময় তোমার পতনের সূচনা করলেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।
চতুর্থত, যারা তোমার চেয়ে কম ভাগ্যবান, জীবন যাদের জন্য আশীর্বাদ হয়ে আসেনি, সেই দরিদ্রদের জন্য, সুবিধাবঞ্চিত মানুষদের জন্য সবসময় কিছু করার চেষ্টা কর। তাদের থেকে আলাদা হয়ে যেও না কিংবা তাদের অস্তিত্বকে অগ্রাহ্য করো না। চিন্তা করো কীভাবে তাদের জীবনকে আরেকটু সুন্দর করা যায়, কীভাবে তাদেরকে টেনে তোলা যায়। অন্যকে সাহায্য করার জন্য তোমার ক্ষুদ্র এই প্রচেষ্টাগুলো আসলে অনেক মহৎ, অনেক গুরুত্বপূর্ণ। পৃথিবীর ইতিহাসে যখনই কোনো সমাজ তার সমস্ত মানুষ্কে নিয়ে সামনে এগিয়ে যেতে চেষ্টা করছে, কাউকে অবহেলা করে পেছনে সরিয়ে রাখেনি, তখন থেকেই তার প্রকৃত উন্নয়ন শুরু হয়েছে।
পঞ্চমত, সত্য ও সততা- এই গুণগুলোকে অর্জন করা যতটা অসাধ্য বলে মনে করা হয় তেমনটা মোটেও নয়। তুমি যদি সত্যই চাও, তাহলে এটা পানির মতই সহজ ও সরল একটা ব্যাপার। হ্যাঁ, এটা সত্যি যে উচ্চাকাঙ্ক্ষা কিংবা জীবনের নানা চাহিদা প্রায়ই সততার পথে বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়। এ দুটোর মধ্যে একটা যৌক্তিক ও গ্রহণযোগ্য ভারসাম্য বজায় রাখতে হয়ত তোমার জীবনের অনেকটা সময়ই পার হয়ে যাবে। কিন্তু বিশ্বাস কর, এই ভারসাম্য এতটাই দরকারি আর মূল্যবান, যে এর জন্য আজীবন চেষ্টা করার মধ্যেও কোনো গ্লানি নেই। এই ব্যাপারটিকে ভারতে আমরা বলি, 'সত্যমেভ জয়তে' অর্থাৎ সত্যের জয় হবেই। এটিই ছিল মিক জ্যাগারের সাথে আমার যৌথভাবে করা প্রথম গানের নাম।
(২০১২ সালের মে মাসে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের মায়ামী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনে এ আর রহমান এই বক্তৃতা দেন।)

No comments

Featured post

একনায়িকাতন্ত্র

আমার বুকের ভেতরের "মন" নামক রাষ্ট্রে ভালোবাসার অজুহাতে যে স্বৈরাচারী শাসন ব্যবস্থা চলছে, তার নাম একনায়িকাতন্ত্র। নায়িকার ইচ্ছেমতো...

Powered by Blogger.