আমার দিন: ইমোশনাল ব্যাংক একাউন্ট ::জাকারিয়া স্বপন
এমন পরিবার নিশ্চয়ই আমাদের চারপাশে অনেক আছে, যা কেবল টিকে আছে সন্তানদের মুখের দিকে তাকিয়ে, নয় তো শারীরিক সম্পর্কের কারণে, নয় তো সামাজিক চাপ কিংবা সন্মানহানী হবে এই ভয়ে। সবসময় যে এভাবেই সংসার টিকিয়ে রাখা যায় তা নয়। একটা সময়ে গিয়ে খুব নোংরাভাবেই শেষ হয় সম্পর্কগুলো। তারপর যারা একদিন ভালোবাসার কথা বলে সংসারে প্রবেশ করেছিলেন, তারাই সারাক্ষণ সেই মানুষটির অসংখ্য পাপের কথা বলতে থাকেন। পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ শূন্য তো অনেক ভালো, নেগেটিভে গিয়ে ঠেকেছে। কিন্তু কেন?
বিগত তিনটি পর্বে লিখেছিলাম, এই পৃথিবীর ইফেক্টিভ মানুষদের তিনটি অভ্যাস নিয়ে। ড. স্টিফেন কোভে-এর লেখা ‘দি সেভেন হ্যাবিট অফ হাইলি ইফেক্টিভ পিপল’ বইটির প্রথম তিনটি অভ্যাসকে বলা হয়েছে ‘ব্যক্তিগত বিজয়’ বা প্রাইভেট ভিক্টরি হিসেবে। অর্থাৎ ওই তিনটি অভ্যাস মূলত আপনার ভেতরের মানুষটিকে ঠিক করে দেবে, আপনার চরিত্র গঠনে সহায়তা করবে। প্রথম অভ্যাসটিতে বলা হয়েছে, আপনিই হলেন আপনার মালিক। আর দ্বিতীয় অভ্যাসে বলা হয়েছে, আপনিই আপনার কাজের ধারাটি ঠিক করেন। আর তৃতীয় অভ্যাসটি হলো, সেই পরিকল্পনাকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার প্রক্রিয়া (প্রথমের বিষয়টিকে প্রথমে বসানোর ক্ষমতা অর্জন করা)। এই তিনটি অভ্যাস যদি আপনি আয়ত্ব করতে পারেন, তাহলে আপনি বিশাল একটি কাজ করে ফেলেছেন। নিজেকে জয় করার পথে এগিয়ে গিয়েছেন।
বইটির পরের তিনটি অভ্যাসকে যে গ্রুপে ধরা হয়েছে তা হলো- ‘পাবলিক ভিক্টোরি’ বা গণমানুষের সাথে বিজয়। পরবর্তী অভ্যাস তিনটি লেখার আগে একটু ভূমিকা লেখার প্রয়োজন দেখা দিয়েছে। আজকের চ্যাপ্টারে থাকছে সেই ভূমিকা পর্ব যার শিরোনাম দেখে নিশ্চই অনেকেই ভিমরি খেয়েছেন। পৃথিবীতে এমন অদ্ভুত ব্যাংকের নাম এবং সেই ব্যাংকে একাউন্ট খোলার বিষয়টি পরিষ্কার হওয়ার প্রয়োজন রয়েছে।
কনসেপ্ট
আমরা প্রচলিত ব্যাংক একাউন্ট সম্পর্কে জানি, যেখানে আপনি জামানত রাখতে পারেন এবং ইচ্ছেমতো টাকা তুলতে পারেন (উইথড্রয়াল)। আপনি সেখানে টাকা ধীরে ধীরে জমাতে থাকেন যেন মুনাফাটাও আপনি পেতে পারেন ঠিকমতো, তবে একাউন্টে উত্তোলন বেশি হয়ে গেলে আপনি আর টাকা তুলতে পারবেন না।
ইমোশনাল ব্যাংক একাউন্টের কনসেপ্টাও অনেক তেমনই। মানুষের সাথে সম্পর্কের ক্ষেত্রে একই ধরনের মেটাফোর ব্যবহার করা হয়েছে। একটি সম্পর্কে আপনি কতটা বিশ্বাস তৈরি করতে পেরেছেন, ওটাই হলো আপনার জামানত। অন্য একজন মানুষ আপনাকে কতটা নিরাপদ মনে করে, সেটাই হলো তার কাছে আপনার ইমোশনাল ব্যাংক একাউন্টের ব্যালেন্স।
ওই ব্যাংক একাউন্টে আপনি ভদ্রতা, মমতা, হৃদ্যতা, প্রতিশ্রুতি রক্ষা ইত্যাদির মাধ্যমে আপনার রিজার্ভ বাড়াতে পারেন। ধরুন- আপনার কাছে আমি একটি ইমোশনাল ব্যাংক একাউন্ট খুললাম। সেখানে উপরের গুণাবলী দিয়ে যদি আপনার সাথে সম্পর্কটি রাখতে পারি, আপনি আমাকে যদি নিরাপদ মনে করেন তাহলেই আপনার কাছে আমার রিজার্ভ বেড়ে গেল। আমি চাইলে সেই রিজার্ভ থেকে তখন টাকা তুলতে পারি। আমি যদি মাঝে মাঝে ভুলও করি, আপনি সেটা বুঝবেন। কিন্তু আপনি ক্ষুব্ধ হবেন না, কারণ আপনার কাছে আমার রিজার্ভ রয়েছে, আমার প্রতি আপনার একটি আস্থা তৈরি হয়েছে।
আবার এই আমি যদি আপনাকে সন্মান না দেখাই, শ্রদ্ধাশীল না হই, আপনাকে বিপদে ফেলি, আপনাকে অগ্রাহ্য করি, আপনার বিশ্বাসকে সন্মান না করি, আপনাকে ভয় দেখাই, আপনার দুর্বলতাকে জনসম্মুখে প্রকাশ করে দেই, তাহলে কি আমার সেই একাউন্টটিতে কোনোও রিজার্ভ থাকবে? আপনি কি আমার উপর আস্থা রাখবেন? আমি মূলত একাউন্টটি হারাব। এটাই হলো ইমোশনাল ব্যাংক একাউন্ট।
আরেকটি উদাহরণ দিলে বিষয়টি পরিষ্কার হতে পারে। আমরা প্রতিনিয়ত সন্তানদের বলে যাচ্ছি, সকালে ঘুম থেকে উঠতে হবে, স্কুলে যেতে হবে, ঠিকমতো লেখাপড়া করতে হবে, নিজের কাপড় নিজে ধুতে হবে, লাইটটা অফ করো, খাবারটি বেড়ে নাও, চুল কেটে আসো, ময়লা প্লেটটা পরিষ্কার করো ইত্যাদি। আমাদের প্রত্যাশার শেষ নাই। কিন্তু আমরা কি একবারও ভেবে দেখেছি, সেই সন্তানের কাছে আমাদের ইমোশনাল ব্যাংক একাউন্টের অবস্থাটা কি? ওটা কি শূন্য, নাকি কিছু অবশিষ্ট আছে? একটা সময়ে গিয়ে ডিপোজিটের চেয়ে উইথড্র বেশি হয়ে যায়। তখনই বিপদ।
বাচ্চাদের সাথে অ্যাফেক্টিভ সম্পর্ক তৈরি করতে হলে আপনার রিজার্ভ লাগবে। আপনার যে ছেলেটি মোটেও আপনার কথা শুনে না, তার জন্য শর্তহীনভাবে কিছু করুন, তার পছন্দের জিনিসটা উপহার দিন, তার সাথে হাঁটতে যান, একসাথে তার স্কুলের কোনোও একটি সমস্যার সমাধান করুন, দেখুন আপনার ব্যালেন্স বেড়ে গেছে। ছেলেটি তখন আপনার কথাকে মূল্য দেবে।
ড. স্টিফেন কোভে ছয়টি উপায়ে ইমোশনাল ব্যাংক ব্যালেন্স বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছেন। আমি সেগুলো এখানে আমার মতো করে লিখে দিচ্ছি।
১. প্রতিটি মানুষকে বুঝতে পারা
এই গ্রহের প্রতিটি মানুষ আলাদা এবং তাদের চাহিদা আলাদা, পছন্দ-অপছন্দ আলাদা, চাওয়া-পাওয়ার ব্যাপ্তিও আলাদা। আপনি ভাবলেন, এই মানুষটির সাথে এক বেলা হাঁটতে গেলে ভালো হয়, কিন্তু দেখা গেল হাঁটাহাঁটি তিনি চরম অপছন্দ করেন। সেক্ষেত্রে আপনার হিতে বিপরীত হতে পারে। তাই কারো ইমোশনাল ব্যাংক একাউন্টে রিজার্ভ বাড়ানোর জন্য সেই মানুষটিকে বুঝতে পারাটা জরুরি। আপনার যে মেয়েটি পিংক রঙের একটি ব্যাগ চাইছে তাকে সেটা যদি কিনে দেন তাহলে তার একাউন্টে রিজার্ভ অনেক বেড়ে যেতে পারে। আবার তাকেই বেগুনী রঙের কাপড় কিনে দিলে সেটাতে সে পছন্দ নাও করতে পারে, এবং আপনার জন্য সেটা রিজার্ভ থেকে উইথড্র।
এমন আরও একটি উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে, যা আপনাকে বুঝতে সাহায্য করতে পারে। স্টিফেন কোভের একজন বন্ধু তার ছেলেকে দেখলেন বেসবল খেলাতে বেশ আগ্রহ তৈরি হয়েছে। ছেলেটির বাবা এটা দেখে ছেলেটির জন্য পরবর্তী বেসবল লিগের প্রতিটি টিমের একটি করে খেলা দেখার ব্যবস্থা করলেন। এর জন্য তার ছয় সপ্তাহ সময় ব্যয় হলো এবং সাথে বেশ অনেকগুলো টাকা। শেষ খেলা দেখে যখন তারা বাড়ি ফিরছিল তখন ছেলেটি তার বাবাকে জিজ্ঞেস করল, বাবা তুমি কি বেসবল সেরকম পছন্দ করো?
বাবা উত্তর দিলেন, না। তবে আমি আমার ছেলেকে সেরকম পছন্দ করি।
প্রতিটি মানুষকে যতটা গভীরে বুঝতে পারবেন এবং সেভাবে তাকে বিবেচনা করবেন, আপনার রিজার্ভ বেশি হওয়ার সম্ভাবনা তত বেশি।
২. ক্ষুদ্র বিষয়গুলোকে মূল্য দেওয়া
সম্পর্কের একটি মূল কথা হলো, ক্ষুদ্র বিষয়গুলোই হয়ে ওঠে সবচে’ বড় বিষয়; আর বড় বিষয়গুলো হয়ে যায় গৌন। এটাই পৃথিবীর যেকোনোও সম্পর্কের গোপন কথা।
আপনি একজন মানুষকে খুব দামি একটি উপহার দিলেন। তাতে হয়তো তিনি সাময়িক খুশি হবেন। আবার আরেকটি মানুষকে আপনি তেমন কোনোও উপহার দিলেন না, কিন্তু তিনি গাড়িতে ওঠার সময় ভদ্রতা করে দরজাটা খুলে দিলেন। কার কাছে আপনার রিজার্ভ বেশি হবে বলে মনে হয়? যাকে আপনি সামান্য সৌজন্যতা দেখিয়েছেন, যাকে আপনি সন্মান দেখিয়েছেন, যার প্রতি আপনি ভালোবাসা দেখিয়েছেন।
আপনি দাওয়াত দিয়ে খুব ভালো ভালো খাবার খাওয়ালেন, কিন্তু যাওয়ার সময় অতিথিকে সামান্য হাসিমুখে বিদায় দিলেন না, তাকে ঠিকমতো সময় দিলেন না, কিংবা অতিথির মনে হলো তাকে অবহেলা করা হয়েছে, সেই অতিথি কিন্তু নিজেকে গুটিয়ে নেবে। তার ইমোশনাল ব্যাংক একাউন্টে আপনার ব্যালেন্স কমে যাবে।
তাই ছোট ছোট বিষয়গুলোর প্রতি খেয়াল রাখুন।
৩. প্রতিশ্রুতি রাখুন
আপনি যদি কাউকে কোনোও প্রতিশ্রুতি দিয়ে থাকেন এবং সেটাকে রক্ষা করেন, তাহলে এর চেয়ে বড় ডিপোজিট আর হতে পারে না। আবার উল্টোটাও সত্যি। আপনি প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করলেন। এর থেকে বড় উইথড্র আর হতে পারে না। আপনি একটি প্রতিশ্রুতি ভেঙে বড় ধরনের উইথড্র করে ফেললেন। আপনার ব্যালেন্স কমিয়ে ফেললেন।
যাদের বাসায় সন্তান আছে তারা এর সরাসরি ফলাফল দেখতে পারেন। পিতা-মাতা হিসেবে আমরা বাচ্চাদের অনেক ধরনের প্রতিশ্রুতি দিয়ে থাকি। সেই প্রতিশ্রুতি আপনি ভেঙেছেন তো মরেছেন; সন্তানদের কাছে আপনার রিজার্ভ শূন্যের ঘরে। এর চেয়ে প্রতিশ্রুতি না দেওয়াটাই সবচে’ উত্তম কাজ। আর যদি কখনও জরুরি কিছু চলে আসে যা আপনি এড়াতে পারছেন না, তাহলে সেটা বাচ্চাদের খুব সময় নিয়ে পরিষ্কার করে বুঝিয়ে বলুন। নইলে তারা ভবিষ্যতে আপনার আর কোনোও প্রতিশ্রুতিই বিশ্বাস করবে না।
এটা পিতামাতা হিসেবে বাচ্চাদের সাথে যেমন প্রযোজ্য, তেমনি বাইরের মানুষের সাথেও প্রযোজ্য। আপনি যখনই আপনার প্রতিশ্রুতিগুলো রাখতে শুরু করবেন, আপনার উপর বিশ্বাস এবং আস্থা হাজার গুণে বেড়ে যাবে। এবং তখন আপনি যা-ই বলবেন, সেটা মানুষ গ্রহণ করবে। আমরা অনেক সময় কথায় কথায় অনেক প্রতিশ্রুতি দিয়ে ফেলি। সেটা মূলত আপনার ব্যাংক একাউন্টকে শূন্যের কোঠায় নামিয়ে নিয়ে আসছে।
তাই যখনই কোনোও প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, সেটা রাখার সবটুকু চেষ্টা করবেন; নইলে প্রতিশ্রুতি দেবেন না।
৪. প্রত্যাশা ঠিক করুন
আমাদের সম্পর্কে যত ঝামেলা পাকায় তা হলো প্রত্যাশা। আপনার কাছে কে কী প্রত্যাশা করে বসে আছে, কিংবা আপনি কার কাছে কী প্রত্যাশা করে বসে আছেন, সেটার গরমিল হলেই সেখানে ডিপোজিট কমতে থাকে। এমন-কি কর্মক্ষেত্রেও খেয়াল করুন, আপনি ভাবলেন এটা আপনার সহকর্মী করে দেবেন, আর উনি ভাবলেন আপনার নিজেরই তো সেটা করার কথা। তারপর তৈরি হলো দূরত্ব।
সম্পর্কের ক্ষেত্রে প্রত্যাশা ঠিক করে দেওয়াটা হলো সবচে’ কঠিন কাজ। এবং এটা যে কেবল আপনি ঠিক করলেই অপরপক্ষ বুঝে নিবে তা কিন্তু নয়। সে যে ঠিকমতো বুঝেছে, সেটা নিশ্চিত করাটাও জরুরি। আপনি বিয়ের দাওয়াতে গেলেন কাচ্চি বিরিয়ানী খাবেন বলে, কিন্তু গিয়ে দেখেন মেনু হলো সাদা ভাত আর সবজি! কেমন লাগবে তখন আপনার? কিংবা প্রত্যাশা করলেন, প্রমোশনটা এবার হবেই। কিন্তু প্রমোশন তো অনেক দূরে, চাকরি ছাঁটাইয়ের নোটিশ পেলেন। এমন প্রত্যাশা এবং তা পূরণের ফারাক যদি থাকে কোনোও সম্পর্কে, তাহলে সেখানে আপনার রিজার্ভ শূন্য হতে বাধ্য।
ডিপোজিট বাড়ানোর জন্য সঠিক প্রত্যাশাটা ঠিক করে নিন এবং বুঝিয়ে দিন। এটা করতে বেশ সাহসের প্রয়োজন হয়। অনেক সময় মুখ ফুটে কথাগুলো বলা যায় না। কিন্তু সেই না-বলা কথাই হয়তো ভুল প্রত্যাশার জন্ম দিল। তাই একসাথে কাজ করতে গেলে অবশ্যই প্রত্যাশা ঠিক করে মাঠে নামুন। ভবিষ্যতে ভালো ফল পাবেন।
৫. পারসোনাল ইন্টিগ্রিটি
পারসোনাল ইন্টিগ্রিটি একটি মানুষের উপর আস্থা তৈরি করে এবং আমাদের সম্পর্কের বহুবিধ ডিপোজিটের ভিত্তি। আপনার যদি ইন্টিগ্রিটি না থাকে, তাহলে উপরের যে পদ্ধতিগুলোর কথা বলা হলো তার কোনোটাই কাজে লাগবে না। আপনি অন্য মানুষকে খুব ভালো বুঝতে পারেন, তার ক্ষুদ্র বিষয়গুলোতে খুব নোটিশ করেন, তার সাথে প্রতিশ্রুতি ভাঙেন না, প্রত্যাশাগুলো সঠিকভাবে নির্ণয় করেন এবং সেগুলো পূরণ করেন, এবং তারপরেও আপনার রিজার্ভ শূন্যের ঘরে থাকতে পারে শুধু ইন্টিগ্রিটি না থাকার কারণে।
অনেকেই ইন্টিগ্রিটিকে সততার সাথে মিলিয়ে ফেলেন। বিষয়টি আসলে তা নয়। সততা হলো আপনি সত্যি কথাটি বলবেন। আর ইন্টিগ্রিটি হলো আপনার সবকিছু মিলিয়ে এমন একটি চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য, যা আপনার একটি সত্ত্বা তৈরি করে।
ইন্টিগ্রিটি তৈরির সবচে’ ভালো উপায় হলো, তাদের প্রতি অনুগত থাকা যারা আপনার সামনে উপস্থিত নেই। বিষয়টি আরেকটু খুলে বলা যেতে পারে। ধরুন, আপনি আপনার সহকর্মী মিলে অপর একজন সহকর্মীকে নিয়ে কথা বলছেন, তাকে নিয়ে এমন কিছু বলছেন যা তার সামনে হয়তো বলতেন না। অর্থাৎ যে মানুষটি উপস্থিত নেই তার প্রতি আপনি অনুগত থাকছেন না; তাকে আপনি রক্ষা করছেন না। আপনি আপনার ইন্টিগ্রিটি হারাচ্ছেন। আপনার যদি ইন্টিগ্রিটি থাকে তাহলে আপনি সেই ব্যক্তিটিকে সামনে ডেকে এনে বলবেন, ঠিক কোন জায়গায় তিনি ভুলটি করেছেন কিংবা ঠিক কোথায় ঝামেলাটা হয়েছে।
ছোটবেলায় সিনেমায় দেখেছিলাম, একজন ভদ্র নারী আরেকজনকে বলছেন, ‘খালা গো, আপনাকে একটা গোপন কথা কই, আর কাউরে কইয়েন না। আপনে আপন মানুষ বইল্যা কইতাছি। ওই বাড়ির বউ কিন্তু পোয়াতি...’। এটা শুনে খালার চোখ বড় বড় হয়ে যায়। এবং সেই ভদ্র নারী আবারও বলেন, ‘কাকপক্ষীও যেন না জানে গো’। এবং তিনি একই কথা পাড়ার সবাইকে বলে বেড়াচ্ছেন। এমন দৃশ্য নিশ্চয়ই আপনারাও দেখেছেন।
আপনি সবাইকে একই নীতি দিয়ে বিচার করুন। ইন্টিগ্রিটি তৈরি হয়ে যাবে। প্রথম প্রথম অনেকেই আপনার সাথে তর্কে জড়িয়ে যাবে; ক্ষুদ্র যুদ্ধ হবে। কিন্তু একটা সময়ে গিয়ে আপনি জিতে যাবেন।
৬. ত্রুটি স্বীকার করুন
আপনি যখনই ইমোশনাল ব্যাংক একাউন্ট থেকে কিছু উত্তোলন করবেন, তার ক্ষতিপূরণ করতে হলে আপনাকে ক্ষমা চাইতে হবে। এবং সেটা সঠিকভাবেই করতে হবে।
-- আমি ভুল করেছিলাম
-- আমি সহানুভুতি দেখাইনি
-- আমি তোমাকে সন্মান দেখাইনি, দুঃখিত
-- আমি তোমাকে প্রাপ্য মর্যাদা দেইনি এবং আমি দুঃখিত
-- আমি তোমার বন্ধুদের সামনে তোমাকে বিব্রত করেছি, যা আমার উচিত হয়নি। যদিও আমি বিষয়টি পরিষ্কার করে বুঝাতে চেয়েছিলাম, কিন্তু কাজটা আমি ভালোভাবে করতে পারিনি। আমি দুঃখিত।
মন থেকে এই ধরনের কথা বলতে পারার জন্য প্রচণ্ড মানসিক চারিত্রিক শক্তির প্রয়োজন। যে মানুষটার গভীরে ভিত অনেক শক্ত, যার নীতি প্রচণ্ড রকম প্রখর, কেবল সেই মানুষটাই এভাবে ক্ষমা চাইতে পারে। এর বাইরে এভাবে ক্ষমা চাইবার মতো সৎ সাহস আর কেউ দেখাতে পারবে না। কেউ হয়তো অভিনয় করে ওভাবে দেখাতে পারবে। কিন্তু সত্যিকার অর্থেই দুঃখিত হয়ে এভাবে ক্ষমা চাইবে একমাত্র সেই ব্যক্তি, যে ভেতরে অনুভব করবে তার ইন্টিগ্রিটিতে একটু ঝাঁকুনি লেগেছিল; কিংবা বিশেষ কোনোও মুহূর্তে খেয়াল না করে কাজটি করে ফেলেছেন। তিনি তৎক্ষণাৎ সেটা বুঝতে পেরেই ক্ষমা চাইবেন।
যাদের ভেতর নিরাপত্তার অভাব রয়েছে, তারা এই কাজটি করতে পারবে না। তারা আরও বেশি ভালনারেবল হয়ে উঠবে। তারা ভাববে, এইভাবে ক্ষমা চাওয়াটা তাদেরকে দুর্বল এবং নরম করে ফেলবে। এবং তারা ভয় পায় অন্যেরা বুঝি তাদের এই দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে নেবে। অন্য মানুষের মতামতের উপর তাদের নিরাপত্তা নির্ভর করে। তারা ভয় পায়, অন্যরা তাদের সম্পর্কে কী ভাবল। তারা নিজের দোষকে জাস্টিফাই করার জন্য অন্যের দোষকে সামনে নিয়ে আসে।
সত্যিকার অর্থে ক্ষমা চাইলে আপনার ডিপোজিট বাড়বে। আর বার বার ক্ষমা চাওয়ার মতো কাজ করলে আপনার ক্ষমাটাকে কেউ সিরিয়াসভাবে নেবে না; এবং আপনার জন্য সেটা হবে বিশাল উইথড্রয়াল। আপনার সম্পর্কে অবনতি ঘটবে।
এবারে আসি লেখাটা শুরু করেছিলাম যা দিয়ে। আমাদের চারপাশে এমন অজস্র উত্তাপহীন সম্পর্ক রয়েছে যা নানান কারণে টিকে আছে। কেউ কেউ মানুষকে দেখানোর জন্য বাইরে এসে হাত ধরে হাঁটবে, নয় তো জড়িয়ে ধরে হাসি দেবে। মানুষ ভাববে, আহ কত সুখী দম্পতি। কিন্তু দরজার ওপারে তারা কেউ কারও সাথে কথা বলে না। যোগাযোগহীন সম্পর্ক। এর মূল কারণ হলো, তাদের কারও কোনোও ডিপোজিট নেই। তাদের হয়তো প্রচলিত ব্যাংক একাউন্টে অনেক ডিপোজিট আছে, কিন্তু ইমোশনাল ব্যাংক একাউন্টে ডিপোজিট শূন্য।
প্রতিটি সম্পর্কই আলাদা। সেই সম্পর্কগুলোর ইমোশনাল ব্যাংক একাউন্টে রিজার্ভ বাড়ান।
(চলবে)
No comments