আমার দিন: দাবায় রাখতে পারবা না!::জাকারিয়া স্বপন
অনেক দিন ধরেই ভাবছিলাম, এই পৃথিবীতে যারা অনেক বেশি এ্যাফেক্টিভ মানুষ তাদের নিশ্চয়ই কোনোও একটি প্যাটার্ন আছে। কোথাও না কোথাও তাদের ভেতর একটা বিনে সুতার মালা আছে, যা দিয়ে তাদেরকে একত্রে বাঁধা যায়। কি সেই প্যাটার্ন?
অনেক দিন আগে একটা বই কিনেছিলাম, যা কয়েকদিন ধরে পড়ার চেষ্টা করছি- ড. স্টিফেন কোভে-এর লেখা ‘দি সেভেন হ্যাবিট অফ হাইলি এ্যাফেক্টিভ পিপল’। এই বইটি বিগত ২৫ বছরের বেশি সময় ধরে মানুষকে আলোড়িত করেছে। এবং এখন পর্যন্ত প্রায় আড়াই কোটির বেশি বিক্রি হয়েছে। বর্তমান সময়ের অনেক বিখ্যাত মানুষ এই বইটি সম্পর্কে বলেছেন, ড. কোভের গবেষণা এবং তার উপর লেখা এই বইটি তাদের জীবনকে প্রভাবিত করেছে। এবং অনেক ক্ষেত্রে সেগুলো তাদের সাথে মিলেও গেছে।
সুযোগ পেলেই আমি বিভিন্ন এ্যাফেক্টিভ মানুষের কাজের ধরন এবং তাদের দর্শন পড়ার চেষ্টা করি। এই বইতে যে সাতটি অভ্যাসের কথা বলা হয়েছে সেগুলোকে আমার বেশ যুক্তিযুক্ত মনে হয়েছে। বিখ্যাত এ্যাফেক্টিভ ব্যক্তিদের কাজের ধারার সাথে মিলিয়ে দেখলে একটা সুন্দর মিল পাওয়া যায়। আমি মনে করি, এটা বর্তমান সময়ের মানুষ, পিতা-মাতা, ছাত্র-ছাত্রী থেকে শুরু করে অফিসের একজন নিবেদিত প্রাণ কর্মীও পড়ে দেখতে পারেন। এবং তার কিছু কিছু নিজের ওপর প্রয়োগ করে অনেক বেশি এ্যাফেক্টিভ হতে পারেন। আজকে লিখছি, প্রথম অভ্যাসটি নিয়ে যাকে ইংরেজিতে বলা হচ্ছে ‘প্রোএ্যাক্টিভ’।
‘প্রোএ্যাক্টিভ’ শব্দটির সঠিক অর্থ কী, সেটা এক কথায় বুঝিয়ে বলা কঠিন। অনেকেই মনে করতে পারেন, করিৎকর্মা। নয়তো কোনোও কিছু ঘটার আগেই সেটা করে ফেলা কিংবা কোনোও কাজ শেষ করার জন্য চাপ প্রয়োগ করা, অথবা ইতিবাচক ব্যবহার ইত্যাদি। কিন্তু আসলে এগুলোর কোনোটাই নয়। প্রোএ্যাক্টিভ বিষয়টি বুঝতে হলে আরও কিছু বিষয় বুঝতে হবে। এই মুহূর্তে শুধু বলে রাখছি, প্রোএ্যাক্টিভ শব্দটির উল্টো অর্থ হলো ‘রিএ্যাক্টিভ’। বাংলায় এর যুৎসই প্রতিশব্দ পাইনি বলে এখানে ইংরেজি শব্দ দুটোই ব্যবহার করছি।
সামাজিক আয়না
আমাদের চারপাশে একটি সামাজিক আয়না আছে, যা আমরা দেখতে পাই না। তবে আয়নার অস্তিত্ব বুঝতে পারি। আয়নায় আমাদের কেমন দেখতে লাগে, সেটা দেখতে পাই। এটা সব সমাজের জন্যই প্রযোজ্য। সেই আয়নায় কেমন দেখায় আপনাকে?
- ‘তুমি তো কখনই ঠিক সময়ে উপস্থিত থাকো না?’
- ‘তুমি তো কখনও সত্যি কথা বলো না?’
- ‘তুমি তো সামান্য জিনিসটাও ম্যানেজ করতে পারো না?’
- ‘তুমি তো অনেক ভালো গান গাও!’
- ‘তুমি তো রাক্ষসের মতো খাও!’
- ‘আমার বিশ্বাসই হচ্ছে না, তুমি এই পুরস্কার পেতে পারো!’
- ‘বিষয়টা এত সহজ, তুমি বুঝছ না কেন!’
এমন হাজারও নিজের ছবি সেই আয়নায় আপনি দেখতে পাবেন। এর সবগুলো যে সত্যি তা নয়। এর অনেকগুলোই হয়তো শুধু পারসেপশন। কিন্তু মানুষ আপনাকে এভাবেই দেখে থাকে। এবং এর বেড়াজালে আটকে যায় আমাদের জীবন, বেড়ে ওঠা এবং কাজকর্ম, সর্বোপরি এ্যাফেক্টিভনেস।
সামাজিক এই মাপকাঠি মূলত তিনটি বড় দাগে ভাগ করা যায়। একটি হলো জেনেটিক- বিষয়টি এমন যে, আপনার দাদা করতেন তাই আপনার ভেতরও সেটা আছে। আপনার দাদার মাথা গরম ছিল, তাই আপনার ভেতরও সেই বৈশিষ্ট্য রয়েছে। এমন কথা নিশ্চয়ই আপনি অনেকবার শুনেছেন। অনেকেই বলবে, এটা তোমার ডিএনএ-এর ভেতর রয়েছে। এটা তুমি জন্মসূত্রে পেয়েছ।
দ্বিতীয়টি হলো সাইকিক- অর্থাৎ আপনার মা-বাবা আপনাকে এটা করতে শিখিয়েছে, কিংবা আপনি যেভাবে বেড়ে উঠেছেন তার প্রভাব। আপনার ছোটবেলার ব্যবহার আপনাকে এভাবে গড়ে তুলেছে। সেকারণেই আপনি কোথাও দাঁড়িয়ে বক্তৃতা করতে ভয় পান, আপনি কোনোও একটি ভুল কাজ করে ফেললে সেটা স্বীকার করতে ভয় পান (কারণ তখন আপনার চোখে মা-বাবার কঠিন মূর্তিটি ভেসে ওঠে)। আপনার মনে জেগে ওঠে অন্যদের সাথে আপনাকে তুলনা করার মানসিক যন্ত্রনা, আপনি ক্লাসে প্রথম হতে পারেননি কিন্তু পাশের বাড়ির ছেলে প্রথম হয়ে গেল ইত্যাদি। এগুলো আমাদের অসংখ্য মানুষের ছোটবেলার ছবি। এভাবেই আমরা বেড়ে উঠি।
তৃতীয়টি হলো পারিপার্শ্বিক- অর্থাৎ আপনার চারপাশের পরিস্থিতি। যেমন আপনি বলতে পারেন, আপনার বস (চাকরি ক্ষেত্রে) এটা করছে, কিংবা আপনার স্ত্রী বা স্বামী আপনার জীবনটা নষ্ট করে দিচ্ছে, নয়তো দেশের অর্থনীতি মোটেও ভালো না, সব দুর্নীতিগ্রস্থের ভেতর কাজ করব কীভাবে, কিংবা দেশের নীতিমালা একদমই আপনার পছন্দ নয়।
এমন বিষয়গুলো তো আমাদের মনকে প্রভাবিত করে, জীবনকে পরিচালিত করে। নয় কি? আমরা সবাই কিন্তু এই ধরনের হাজারও বিষয়ের ওপর নির্ভর করে নিজেদেরকে সাজাই, কিংবা রেসপন্স করি। আবার একই বিষয়ে আমরা সবাই কিন্তু একইভাবে রেসপন্স করি না। কিন্তু এই যাবতীয় রেসপন্সের কি কোনোও গ্রামার আছে?
প্রোএ্যাক্টিভিটি
আপনি যদি একটু গভীরে চিন্তা করেন তাহলে বুঝতে পারবেন, আমরা যে রেসপন্স করি সেটা আসলে পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করে করি না। আসলে ওই পরিস্থিতিতে আমরা যা সিদ্ধান্ত নিই, তাই প্রকাশ করি রেসপন্স-এর মাধ্যমে। আপনি যদি রেগে যান, তার অর্থ হলো আপনি রেগে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। আপনি যদি সুখ অনুভব করেন, আসলে আপনি সুখী হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। আমাদের ব্যবহার মূলত আমাদের সিদ্ধান্তের ফলাফল।
যারা খুব বেশি পরিমাণে প্রোএ্যাক্টিভ মানুষ, তারা মূলত ‘রেসপন্সিবিলিটি’-তে বিশ্বাস করেন। রেসপন্সিবিলিটি শব্দটিকে ভাঙলে দাঁড়ায় ‘রেসপন্স’ + ‘এবিলিটি’ অর্থাৎ রেসপন্স করার ক্ষমতা। এই ধরনের মানুষগুলো তাদের নিজেদের ব্যবহারের জন্য কখনই কোনোও পরিস্থিতি, অবস্থা কিংবা পরিবেশকে দায়ী করে না। তারা মনে করে, সে যা ব্যবহার করছে (রেসপন্স করছে) সেটা তার সচেতন মনের সিদ্ধান্ত বা বহিঃপ্রকাশ। কারণ মানুষ প্রকৃতিগতভাবেই প্রোএ্যাক্টিভ। মানুষ প্রকৃতিগতভাবে মনে করে না যে, সে পরিস্থিতির শিকার। সে মানতে চায় না যে, কেউ তাকে নিয়ন্ত্রণ করছে। সে বন্যা, খরা, রোদ, বৃষ্টি, ভূমিকম্প ইত্যাদির কাছে নতি স্বীকার করতে চায় না। মোটকথা সে পরিস্থিতি দ্বারা নিজেকে নিয়ন্ত্রিত হতে দিতে চায় না।
যদি আমরা নিজেকে পরিস্থিতির ওপর ছেড়ে দেই, তখনিই আমরা ‘রিএ্যাক্টিভ’ হয়ে যাই। রিএ্যাক্টিভ মানুষরা পরিস্থিতি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। আজকে যদি আবহাওয়া ভালো থাকে, তাহলে ভালো অনুভব করে। যদি আবহাওয়া ভালো না থাকে, তাহলে তারাও ভালো থাকে না। কিন্তু ‘প্রোএ্যাক্টিভ’ মানুষদের নিজেদেরই আবহাওয়া থাকে। রোদ উঠল নাকি বৃষ্টি হলো, তাতে তাদের কিচ্ছু আসে যায় না। তারা মূলত নিজেদের ‘মান’ দ্বারা পরিচালিত হয়। কেউ যদি মনে করে সে ভালো মানের কাজ উপহার দেবে, তাহলে তার কাছে রোদ-বৃষ্টি-খরা কোনোও কিছুই কোনো বিষয় নয়। তারা সবকিছু উপেক্ষা করে ভালো কাজটি উপহার দিবেই।
‘রিএ্যাক্টিভ’ মানুষগুলো ‘সামাজিক আবহাওয়া’ দ্বারাও নিয়ন্ত্রিত হয়। কেউ তাদেরকে একবেলা ভালো খাওয়ালো, তারা তাতে খুশি হয়। আবার কেউ তাদেরকে দাওয়াত দিল না, তাদের মন খারাপ হয়, তারা ডিফেন্সিভ হয়ে ওঠে। রিএ্যাক্টিভ মানুষরা মূলত অন্য মানুষের ব্যবহারের ওপর নির্ভর করে নিজেদের জীবনকে তৈরি করে। নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য অন্য মানুষকে ক্ষমতাশালী করে। অনেক সময় সে বুঝতেই পারে না, যে অন্য মানুষকে সে তার যাবতীয় নিয়ন্ত্রণের চাবিগুলো দিয়ে রেখেছে। মোট কথা, রিএ্যাক্টিভ মানুষগুলো পরিচালিত হয় অন্যের দ্বারা, আর প্রোএ্যাক্টিভ মানুষগুলো পরিচালিত হয় তার ভেতরের নিজস্ব মানদন্ড দিয়ে, ভ্যালু দিয়ে।
প্রোএ্যাক্টিভ মানুষগুলোকেও বাইরের পরিবেশ প্রভাবিত করে। কিন্তু তারা সেটা দিয়ে পরিচালিত হয় না। তারা ওই পরিস্থিতিতে এমনভাবে সিদ্ধান্ত নেয়, যার চাবিকাঠি তার নিজের ভেতরেই রয়ে গেছে। যেমন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফার্স্ট লেডি এলিনর রুজভেল্ট মতে, ‘আপনার অনুমতি ছাড়া কেউ আপনাকে কষ্ট দিতে পারবে না’। একইভাবে মহাত্মা গান্ধী বলেছিলেন, ‘আমরা যদি কারও হাতে আমাদের আত্মসন্মান তুলে না দেই, তাহলে সেটা কেউ নিয়ে যেতে পারবে না’। একইভাবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন, ‘সাত কোটি বাঙালিকে দাবায় রাখতে পারবা না’।
এরা সবাই খুবই প্রোএ্যাক্টিভ মানুষ ছিলেন। আমরা মূলত নিজেদেরকে দাবায় রাখার জন্য অন্যকে সেই ক্ষমতাটা দিয়ে দেই। আপনি যেদিন বলতে পারবেন, ‘আজকের এই আমি এবং আমার এই অবস্থান, তার জন্য আমার গতকালের সিদ্ধান্তগুলোই দায়ী’ তখনই কেবল আপনি প্রোএ্যাক্টিভ মানুষের দলে নাম লেখাতে পারবেন। দেখে নিন, আপনি প্রোএ্যাক্টিভ নাকি রিএ্যাক্টিভ।
খেয়াল করুন আপনার ভাষা
আমরা নিত্যদিন যা ভাবি, আর যা করি তার বেশিরভাগই উঠে আসে আমাদের ভাষায়। আপনি কীভাবে কথা বলছেন, কীভাবে শব্দ চয়ন করছেন, সেগুলো আপনার অজান্তেই আপনার চিন্তার রাস্তাকে অন্যের কাছে তুলে ধরবে। আপনি নিজেও একটু খেয়াল করে সেগুলো উদ্ধার করতে পারেন। তাহলে বুঝতে সুবিধা হবে, আপনি প্রোএ্যাক্টিভ নাকি রিএ্যাক্টিভ।
নীচের শব্দমালাগুলো খেয়াল করুন-
- এই ব্যাপারে আমি কিছুই করতে পারব না
- আমি তো এমনই (মানলে মানো, না মানলে ভাগো...)
- ও আমাকে পাগল করে ছাড়ছে
- আমাকে এটা করতেই হবে
- দুঃখিত, আমি এটা করতে পারব না
- আমাকে অবশ্যই এটা করতে হবে
- ইস, যদি
এবার ধরুন উপরের বিষয়গুলোতে আরেকজন মানুষ ভিন্নভাবে উত্তর দেয়, কিংবা চিন্তা করে! যেমন -
- চলুন দেখি আমাদের হাতে আর কি অপশন আছে?
- আমি ভিন্ন আরেকটি উপায় বেছে নিতে পারি!
- আমি নিজের অনুভূতি নিয়ন্ত্রণ করি (ও আমাকে পাগল বানাবে কেন!)
- আমি দেখব কোনটা সবার জন্য মঙ্গল
- আমি করতে চাইছি না
- আমি ওটা করতে স্বাচ্ছন্দবোধ করছি
- আমি করব
রিএ্যাক্টিভ মানুষরা প্রথমে লেখা ধাপগুলোর মতো করে ভাববে এবং কথা বলবে। আর প্রোএ্যাক্টিভ মানুষরা নীচের সারিতে লেখা ভাবনাগুলোর মতো ভাববে এবং নিজেকে প্রকাশ করবে। আপনি যখনই বলছেন, ‘আমাকে এটা করতে হবেই’ -এর অর্থ হলো কেউ আপনাকে করতে বাধ্য করছে। আর যদি একই বিষয়ে আপনি বলেন, ‘আমি করতে ইচ্ছা পোষণ করছি’, তার অর্থ হলো কাজটি করতে আপনি নিজেই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। আপনি ক্লাস করবেন, নাকি ফুটবল খেলতে যাবেন সেটা আপনার সিদ্ধান্ত। কেউ আপনাকে জোর করেনি।
সার্কেল অফ ইনফ্লুয়েন্স
এটুকু পড়ার পর নিশ্চয়ই আপনার মনে হবে, কীভাবে প্রোএ্যাক্টিভ হওয়া যায়। এই পৃথিবীতে নিজে একজন এ্যাফেক্টিভ মানুষ হতে চায় না, এমন খুব কম লোক খুঁজে পাওয়া যাবে। আর এ্যাফেক্টিভ মানুষ হওয়ার প্রথম গুনটি হলো প্রোএ্যাক্টিভ অভ্যাসটুকু অর্জন করা। সুখের বিষয় হলো, আপনি চাইলে প্রোএ্যাক্টিভ মানুষ হতে পারেন। তার জন্য আপনাকে ছোটখাটো একটু চর্চা করতে হবে।
আমরা নিত্যদিন হাজারও বিষয় নিয়ে মাথা ঘামাই, বিচলিত হই, আলোড়িত হই, আক্ষেপ করি, হতাশা প্রকাশ করি। যেমন দেশের কী যে হবে, জঙ্গিরা দেশটাকে নষ্ট করে ফেলল, বাচ্চাদের কীভাবে স্কুলে পাঠাব, এই ট্রাফিক জ্যাম আর সহ্য হয় না, এই রোদের গরমে মারাই যাব, সুন্দরবনটা বুঝি আর বাঁচানো গেল না, মিতুকে কেন তার স্বামী বাচ্চাদের সামনে মারতে যাবে, কেন যে প্রমোশন হচ্ছে না, গাড়িটা না কিনলে আর হচ্ছে না, দুষ্টু বাচ্চাটাকে আর কোনোভাবেই নিয়ন্ত্রণে রাখা যাচ্ছে না, এই বুঝি চতুর্থ বিশ্বযুদ্ধ লেগেই গেল ইত্যাদি। এমন অসংখ্য বিষয় প্রতিদিন আমাদেরকে আলোড়িত করে।
একটি বড় বৃত্ত আঁকুন এবং তার ভেতর এগুলো সব লিখে ফেলুন, যা আপনাকে আলোড়িত করছে। এই বৃত্তটির নাম ‘সার্কেল অফ কনসার্ন’। ক্ষেত্র বিশেষ একেকজনের এই বৃত্ত একেক রকমের হবে। একজন কলেজ পড়ুয়া ছাত্রছাত্রীর বৃত্ত আর চাকরিজীবী মানুষের বৃত্ত এবং অবসর যাপন কাটানো একজন মানুষের বৃত্ত ভিন্ন হবে। আবার কাজের প্রকৃতির ওপর ভিত্তি করে এই বৃত্তের বিষয়বস্তু ভিন্ন হবে।
একটু খেয়াল করে যদি তাকান দেখতে পাবেন, এই অসংখ্য বিষয়ের অনেকগুলোতে আপনার করণীয় কিছু নেই; কিংবা আপনার নিয়ন্ত্রণের বাইরে। প্রকৃত অর্থে আপনার নিজের কোনোও নিয়ন্ত্রণ নেই। আবার অনেকগুলো পাবেন যেগুলো আপনার নিয়ন্ত্রণে আছে। এবারে ছোট করে আরেকটি বৃত্ত আঁকুন, যার ভেতরে ওই বিষয়গুলো থাকবে, যেগুলোকে আপনি নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন। এই বৃত্তটির নাম ‘সার্কেল অফ ইনফ্লুয়েন্স’। এই বৃত্তটি আগের বৃত্তটির চেয়ে ছোট হবে এবং ওই বৃত্তটির ভেতরে অবস্থান করবে।
এখন কোন বৃত্তটির ওপর আমরা আমাদের সময় এবং শক্তি ক্ষয় করছি, তার ওপর নির্ভর করবে আপনার প্রোএ্যাক্টিভিটি। প্রোএ্যাক্টিভ মানুষরা ফোকাস করেন ‘সার্কেল অফ ইনফ্লুয়েন্স’-এর ওপর, যেগুলো মূলত তিনি নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন। যে বিষয় তার নিয়ন্ত্রণে নেই, সেটাতে তিনি ফোকাস করেন না। তারা সেই বিষয়গুলোর ওপরই সময় ব্যয় করেন, যেগুলোতে তিনি কিছু একটা করতে পারেন। এবং তারা যখন সেগুলোতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে শুরু করেন, তখন ধীরে ধীরে সেই বৃত্ত বড় হতে থাকে।
অপরদিকে রিএ্যাক্টিভ মানুষরা ফোকাস করেন ‘সার্কেল অফ কনসার্ন’-এ। তারা মূলত অন্য মানুষের দুর্বলতা খুঁজতে ব্যস্ত থাকেন। তারা চারদিকের পরিস্থিতিকে দোষারোপ করেন, পরিবেশকে দায়ী করেন এবং এমন সব বিষয়গুলোকে দায়ী করেন, যেগুলোর ওপর তার নিজের কোনোও নিয়ন্ত্রণ নাই। তারা সর্বদা ব্লেমিং গেমে ব্যস্ত থাকেন এবং তাদের ভেতর সবসময় অন্যকে দোষারূপ করার একটা মানসিক অবস্থা তৈরি হয়। তাদের ভাষা সেভাবেই প্রকাশিত হয়। এবং তারা বিশ্বাস করে, তারা পরিস্থিতির শিকার। তাদের ভেতর এক ধরনের নেতিবাচক বিষয় কাজ করে; এবং যেহেতু তারা সেই কাজগুলোতে ফোকাস করেনি যেগুলোতে তার কিছু করার ছিল, তাই তাদের ‘সার্কেল অফ ইনফ্লুয়েন্স’ দিনকে দিন ছোট হয়ে আসে।
অনেকেই ভেবে থাকেন, প্রোএ্যাক্টিভ মানুষরা খুব বেশি পুশ করে। কিন্তু বিষয়টি মোটেও তা নয়। প্রোএ্যাক্টিভ মানুষরা আসলে স্মার্ট, তারা একটি মান দ্বারা পরিচালিত হন; তারা বাস্তবতা পড়তে পারেন এবং সেটা থেকে বুঝতে পারেন ঠিক কী করা দরকার।
একবার মহাত্মা গান্ধীর দিকে তাকান। যখন সবাই ব্রিটিশদের নিয়ে ‘সার্কেল অফ কনসার্ন’ বড় থেকে বড়ই হচ্ছিল, তখন গান্ধীর ‘সার্কেল অফ ইনফ্লুয়েন্স’ ছিল খুব ছোট। তিনি ওখানেই ফোকাস করলেন। তিনি গ্রামে-গঞ্জে আর ধানক্ষেতের ভেতর দিয়ে নীরবে হেঁটে গেলেন। সেখানে মাঠের মজুরদের সংগঠিত করলেন। তার কোনোও রাজনৈতিক পরিচয় ছিল না, তার কোনোও অফিস ছিল না। কিন্তু তার দৃঢ়তা, ফোকাস, প্যাশন, সাহস, ক্ষুধা এবং নৈতিকতার জোরে পুরো ব্রিটিশকে তার হাঁটুর কাছে টেনে নামিয়েছিলেন। এটা সম্ভব হয়েছিল তার সার্কেল অফ ইনফ্লুয়েন্সের কারণে।
যদি এমন হতো
অনেকেই তাদের ‘সার্কেল অফ কনসার্ন’ এবং ‘সার্কেল অফ ইনফ্লুয়েন্স’ নিয়ে একটু দ্বিধার ভেতর পড়ে যেতে পারেন। ‘মিতু হত্যা’, ‘তনু হত্যা’, ‘রামপালে বিদ্যুৎ কেন্দ্র’, ‘জঙ্গি হামলা’ এগুলোতে কি আপনার কিছু করণীয় নেই? তাহলে এগুলো কি ‘কনসার্ন’, নাকি ‘ইনফ্লুয়েন্স’ বৃত্তে পড়বে?
যে সকল বিষয়গুলো ‘এমন যদি হতো’ টাইপের আখ্যা দেওয়া যায়, সেগুলোকে কোনোও রকম দ্বিধা ছাড়াই সার্কেল অফ কনসার্নে ফেলে দিন। কিছু উদাহরণ দেয়া যেতে পারে। যেমন-
- ইস, আমার বাড়িটার পুরো ঋণ শোধ করতে পারলেই আমি সুখী হতাম!
- ইস, আমার বসটা যদি এমন কড়া না হতো!
- আহ, আমি যদি একজন বাধ্য স্বামী পেতাম!
- আমার সন্তানগুলো যদি একটু বাধ্য হতো!
- আমার যদি এমবিএ ডিগ্রিটা থাকত!
- ইস, আমি যদি আরেকটা সুযোগ পেতাম...
এগুলো হলো উইশ লিস্ট। অপরদিকে ‘সার্কেল অফ ইনফ্লুয়েন্স’ হলো যেগুলো আপনি করতে পারেন। যেমন, আমি তো কম্পিউটার সায়েন্স ডিগ্রি নিতে পারি, আমি তো আরেকটু ধৈর্য্য দেখাতে পারি, আমি আরেকটু বুদ্ধিমান হতে পারি, আমি ওই উপন্যাসটা পড়তে পারি, আমি তো আমার বাচ্চাগুলোকে আরেকটু বেশি সময় দিতে পারি -এগুলো সবই আপনার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যকে ধারণ করে।
আপনার কাজে সমস্যা হচ্ছে, অনেক ঝামেলার কাজ, অনেক অভিযোগ! এই অসংখ্য অভিযোগ এবং সমালোচনা করে কোনোও লাভ আছে? বরং যে সকল ক্ষেত্রে নিজের কিছু করার আছে, সেটাতে ফোকাস করুন। দেখবেন, আপনার সার্কেল অফ ইনফ্লুয়েন্স বাড়তে থাকবে। আপনি ধীরে ধীরে একজন এ্যাফেক্টিভ মানুষ হিসেবে তৈরি হয়ে যাবেন।
শুরু করুন আজই
স্টিফেন তার বইতে একটি সত্যি ঘটনার উল্লেখ করেছেন। সেই গল্পটির মূল কথাটি এখানে লিখে শেষ করি।
স্টিফেন একটি প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহীর সঙ্গে কিছু কাজ করেছিলেন। তিনি ছিলেন প্রচণ্ড মেধাবী, ক্রিয়েটিভ, বুদ্ধিমান এবং দক্ষ। সবাই এটা জানত। কিন্তু তার ব্যবস্থাপনা ছিল অনেকটা স্বৈরশাসকের মতো। সারাক্ষণ তার নিচের টিমকে বলে বেড়াচ্ছেন, এটা করো, ওটা করো, এক্ষুনি এটা শেষ করতে হবে, এক্ষুনি ওটা শেষ করতে হবে।
এমন বসের সঙ্গে কাজ করে মোটামুটি সবাই বীতশ্রদ্ধ। জীবন ত্রাহিত্রাহি। সামনে কেউ কিছু বলতে না পারলেও পেছনে প্রায় সবাই তার সমালোচনা করতে থাকে। করিডোরের আলোচনার বিষয়গুলো হলো,
- আর বলো না, এত দিন ধরে যা করলাম, ওই ব্যাটা এসে সব বাদ দিতে বলল! এখন বলছে, অন্যভাবে করতে হবে!
- এভাবে আর কতদিন চলবে?
- ওর বয়স তো মাত্র ঊনষাট, এখনো তো অবসরে যাওয়ার অনেক বাকি!
- এই ধরনের লোকরা তো কবরে যাওয়ার আগ পর্যন্ত অবসরে যায় না।
কিন্তু এদের ভেতর একজন কর্মী ছিলেন প্রোএ্যাক্টিভ। তিনি তার সার্কেল অফ ইনফ্লুয়েন্সকে কাজে লাগালেন। তিনি উদ্যোগ নিলেন। বুঝতে চেষ্টা করলেন, তার প্রধান নির্বাহী ঠিক কী চাইছেন, তার ভিশনটা বুঝার চেষ্টা করলেন, তার প্রয়োজনটা ধরার চেষ্টা করলেন। তারপর যখন কাজ শুরু করলেন, তিনি পুরো বিষয়টির ভেতর প্রবেশ করে সুন্দর একটি রিপোর্ট দিলেন। শুধু রিপোর্ট দিয়েই ক্ষান্ত হলেন না, সমস্যাটির আরও কিছু সমাধান ব্যাখ্যা করলেন এবং তার সঙ্গে নিজের মতামত জুড়ে দিলেন।
পুরো রিপোর্টটি পড়ে প্রধান নির্বাহী অবাক হলেন। তারপর যখন স্টিফেনের সাথে দেখা হলো তখন তিনি বলছিলেন, স্টিফেন দেখো এই ছেলে করেছে কি! আমি যা চেয়েছিলাম সেটা তো দিয়েছেই, আরও কয়েকটা বাড়তি সমাধানের পথও দেখিয়েছে; এবং কোনটা করলে প্রতিষ্ঠানের ভালো হবে সে বিষয়ে নিজের মতামতও লিখে দিয়েছে।
এরপর থেকেই পরিস্থিতি পাল্টাতে শুরু করল। এরপর যখনই কোনোও মিটিং-এ বসা হয়, সেই বস সবাইকে বলতে থাকেন, এটা করো, ওটা করো; আর সেই ছেলেটির বেলায় বলতে থাকেন, ‘তোমার কি মনে হয়?’ পাল্টে যেতে থাকে নির্ভরতা। এবং একটা সময়ে সেই ছেলেটিই হয়ে ওঠে সকল কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রবিন্দু। একজন এ্যাফেক্টিভ মানুষ।
অনেকেই বলতে পারেন, ধুর এগুলো বাংলাদেশে করে লাভ নাই। তারাই মূলত রিএ্যাক্টিভ মানুষ। তাদের জন্য শুধু একটাই প্রশ্ন, আপনি কি চেষ্টাটুকু করেছিলেন?
No comments