আমার দিন: অভ্যাস ২ - শুরুটা করুন শেষ থেকে!::জাকারিয়া স্বপন
গত সপ্তাহে লিখেছিলাম এই পৃথিবীর এ্যাফেক্টিভ মানুষদের অভ্যাসগুলোর প্রথমটি নিয়ে, যার শিরোনাম ছিল ‘দাবায়া রাখতে পারবা না ’। ওই লেখায় প্রথম অভ্যাসটি দেখানো হয়েছিল ‘প্রোএ্যাক্টিভ’ হিসেবে। আপনি নিজেকে দাবিয়ে রাখার অস্ত্র যদি অন্যের হাতে তুলে দেন, তাহলে আপনি হলেন একজন রিএ্যাক্টিভ মানুষ।
ড. স্টিফেন কোভে-এর লেখা ‘দি সেভেন হ্যাবিট অফ হাইলি এ্যাফেক্টিভ পিপল’ বইটিতে দ্বিতীয় অভ্যাস হিসেবে বলা হয়েছে, আপনি কাজ শুরু করুন শেষ থেকে। আজ আমরা দেখব, কী আছে এর ভেতরে। তবে একটু বলে রাখা ভালো, যেহেতু লেখাটি পত্রিকার পাতায় ছাপা হবে, তাই অনেক কিছুই সংক্ষিপ্ত আকারে লেখা হবে। আমি আরও বিস্তারিত আকারে একটি বই লিখার চেষ্টা করছি। তখন হয়তো বুঝতে আরও সুবিধা হবে। আপাতত মাথায় কনসেপ্টগুলো ঢুকিয়ে দিতে পারলেও মন্দ না। বদলে দিতে পারে আপনার জীবনকে।
শেষের বিষয়টি যেন প্রথমেই মাথায় থাকে
আমাদের বেশিরভাগ মানুষই একটি কাজ শুরু করে দেই; এবং আশায় আশায় থাকি, দেখি এটা কোথায় নিয়ে যায়। কিংবা একটা ব্যবসা শুরু করে প্রচুর মুনাফা আশা করছি, কিন্তু শেষ পর্যন্ত এটাকে কোথায় দেখতে চাই, সেই বিষয়ে পরিষ্কার ধারণা নেই।
একটি উদাহরণ দিলে বিষয়টি পরিষ্কার হতে পারে। ধরুন আপনি ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম যাবেন। আপনি জানেন, বাসে করে চট্টগ্রাম যাওয়া যায়। আপনি একটি বাসে চড়ে বসলেন। আপনি যদি ভুল বাসে চড়ে বসেন, তাহলে আপনি চট্টগ্রাম না গিয়ে দিনাজপুর পৌঁছে যেতে পারেন। যাত্রা শুরুর আগে আপনার গন্তব্য কোথায় সেটা ভালো করে নিশ্চিত হয়ে নিন। গন্তব্য সম্পর্কে আপনার একটি পরিষ্কার ধারণা থাকা জরুরি। এটাই হলো, শেষ থেকে শুরু করার মানসিকতা। আর এটাকে আপনার অভ্যাসে পরিণত করে ফেলুন। এটা ঠিক করে ফেলতে পারলেই, আপনার নিত্য দিনের ব্যবহার এবং কর্মকাণ্ডকে সেটা নিয়ন্ত্রণ করবে।
এটা বুঝার জন্য আরও কঠিন একটি ভার্সন আছে। সেটাও একটু দিয়ে রাখি। যাদের কল্পনা শক্তি ভালো, তারা চেষ্টা করে দেখতে পারেন। আপনি একা একা একটু নিজের মতো থাকুন। কেউ যেন আপনাকে বিরক্ত না করে। এবারে চোখ বন্ধ করে ভাবুন যে, আপনি একজন মৃত মানুষের বাড়িতে গিয়েছেন। সেখানে সবাই তার সম্পর্কে নানান কথা বলছে। তার পরিবারের লোকজন, তার বন্ধু, তার অফিসের সহকর্মী এবং তার পড়শি।
এই চারজন মানুষকে যদি ওই মৃত ব্যক্তিটি সম্পর্কে বলতে বলা হয়, তারা তখন কী বলবে? এবারে নিজেকে আপনি ওই কফিনের ভেতর ভাবুন তো। দেখতে পাচ্ছেন নিজেকে? এবারে দেখুন তো আপনার পরিবারের লোকজন, আপনার বন্ধু, আপনার সহকর্মী এবং আপনার পড়শিরা আপনার সম্পর্কে সেদিন কী বলতে পারে?
আপনি একজন ভালো বাবা ছিলেন, আপনি একজন হৃদয়বান বন্ধু ছিলেন, আপনি একজন সাহায্যকারী সহকর্মী ছিলেন এবং আপনি একজন আনন্দঘন পড়শি ছিলেন। আপনি কি এগুলোই শুনতে চান তাদের মুখ থেকে? আর যদি আপনার পড়শি বলে ওঠেন, আপনি কোনো দিনও তার খোঁজ নেননি, তাদের বাড়িতে যেদিন মৃত্যুর ডাক এসেছিল সেদিনও আপনি দেখতে যাননি, আপনার ছেলেটি যদি বলে ওঠে বাবা তাদের সময় দেননি, নয়তো বন্ধুটি বলে ওঠে- একটি দিনের জন্যেও আপনি তাকে ভালো সঙ্গ দেননি। তাহলে কেমন হবে?
আপনার মৃত্যুর দিনটিতে আপনি তাদের মুখে যা শুনতে চান, সেটা লিখে রাখুন। এটাই আপনার পথ বাতলে দেবে।
সব কিছু দু'বার সৃষ্টি হয়
এই পৃথিবীতে আমরা যা তৈরি করি, তার সবই দু'বার তৈরি হয়। প্রথমে তৈরি হয় আপনার মনে কিংবা ব্রেইনে। আর দ্বিতীয় বার তৈরি হয় বাস্তবে। ধরুন, আপনি একটি বাড়ি তৈরি করবেন। এর যাবতীয় বিষয়গুলো কিন্তু প্রথমে রূপ নিবে আপনার মনের ভেতর। আপনি এটাকে নিয়ে ভাববেন, কোথায় বসার ঘর হবে, থাকার ঘরটা কেমন হবে, রান্না ঘরে কী থাকবে ইত্যাদি বিষয়গুলো মনের ভেতরে তৈরি হয় প্রথম।
তারপর আপনি সেটার একটা রূপ দেন কাগজে কলমে। তখন থেকেই শুরু হয় বাস্তবের কাজ বা দ্বিতীয় বার তৈরি। কেনা হয় ইট, শুরকি, লোহা, সিমেন্ট ইত্যাদি। তৈরি হতে থাকে আপনার স্বপ্নের বাড়ি। অর্থাৎ আপনার বাড়ির একটি ব্লু-প্রিন্ট কিন্তু আপনার মাথায় থাকে। আর সেই ব্লু-প্রিন্ট মেনেই তৈরি হয় বাড়িটি। যদি সেই ব্লু-প্রিন্টে ভুল থাকে তাহলে বাড়িটি ভুলভাবে তৈরি হতে পারে। এবং তখন এর খরচও অনেক বেড়ে যেতে পারে।
একইভাবে একটি ব্যবসার কথা ভাবুন। আপনি প্রথমেই কিন্তু মাথায় একটি ছক কেটে ফেলেন ঠিক কি ব্যবসাটা করবেন, এটার ধরন কি হবে, আয় কোথা থেকে আসবে, সেটার পরিমাণ কেমন হতে পারে, ব্যবসা পরিচালনার জন্য কেমন খরচ হতে পারে, মুনাফার একটি ধারণাও থাকতে পারে; এবং সবশেষে ব্যবসাটি কোথায় যেতে পারে, তারও একটি ধারণা আঁকা হয়ে যায়। তারপর আপনি শুরু করেন দ্বিতীয়বার তৈরির কাজ। যেই মুহুর্তে আপনি ব্যবসাটির শেষটা চোখে দেখতে পারবেন, তখনই আপনি সিদ্ধান্ত নেবেন এই ব্যবসা আপনি করবেন নাকি করবেন না। এভাবে দেখবেন, বেশিরভাগ ব্যবসাই প্রথম তৈরিতেই বন্ধ হয়ে যায়। সেটা আর দ্বিতীয় ধাপে যায় না।
একই কথা সত্য প্যারেন্টিং-এর ক্ষেত্রে। আপনি কীভাবে আপনার সন্তানদের বড় করছেন, তার শেষটি দেখতে পাওয়া জরুরি। আপনি যদি আপনার সন্তানদের যোগ্য, স্ব-নিয়ন্ত্রিত, আত্মসন্মান সম্পন্ন সফল মানুষ হিসেবে দেখতে চান এবং তাদেরকে ভবিষ্যতে ঠিক কোথায় দেখতে চান, সেই বিষয়টি যদি আপনার চোখে পরিষ্কার থাকে, তাহলে তাদের সাথে নিত্য দিনের ব্যবহারটাও আপনি সেভাবেই করবেন। আপনি এমন কিছু করবেন না, যা তাদেরকে হেয় করে ফেলে, তাদের আত্মসন্মানে আঘাত লাগে, কিংবা তাদের নিয়ম-শৃংখলাকে ভেঙে ফেলে।
আপনি যদি সৃষ্টির এই দুটো ধাপ বুঝতে পারেন, তাহলে আপনার ‘সার্কেল অফ ইনফ্লুয়েন্স’ নির্ণয় করতে সহজ হবে। আপনি কতটুকু কোথায় যাবেন, আর কোথায় কতটুকু যাবেন না, সেটা ঠিক হয়ে যাবে। আমরা যদি আগের চ্যাপ্টারটুকু মনে রাখি, তাহলে বলতে হয়- প্রথম অভ্যাসটি হলো, আপনি হলেন আপনার কাজের পরিকল্পনাকারী; আর দ্বিতীয় অভ্যাসটি বলে দিচ্ছে, আপনার প্রথম সৃষ্টি (যা আপনার মাথাতেই আছে)।
নিজের স্ক্রিপ্ট নিজে লিখুন
স্টিভ জবসের বিখ্যাত উক্তিগুলোর মধ্যে সবচে’ বড় একটি হলো, অন্যের জীবনকে নয়, নিজের জীবনকে যাপন করো। অর্থাৎ আমাদের বেশিরভাগ মানুষই অন্যের লেখা স্ক্রিপ্টে তার জীবন যাপন করতে থাকেন। অন্যের লেখা নাটকের স্ক্রিপ্ট যেমন, আপনার জীবনটাও যেন লিখে দিয়েছে অন্য কেউ। কখনও আপনার মা-বাবা, কখনও আপনার শিক্ষক, কখনও আপনার পড়শি, কখনও রাজনৈতিক দলের নেতা, কখনও বা আপনার পরিবার।
অন্যের লেখা স্ক্রিপ্টে জীবন যাপন করে বেশিদূর যেতে পারবেন না। আমাদের ব্রেইনে হাজার রকমের স্ক্রিপ্ট আছে। যেমন গাড়িতে উঠবেন, ভালো করে খেয়াল করুন, কারো একটা স্ক্রিপ্ট আপনার ভেতর চলতে শুরু করেছে। আপনি চাকরিতে প্রমোশন পেয়েছেন, দেখুন যেভাবে নিজেকে সেলিব্রেট করছেন সেই স্ক্রিপ্টটা অন্যের, আপনার লেখা নয়। কোথাও বক্তৃতা দিবেন, অন্যের লেখা স্ক্রিপ্ট চিৎকার করে বলে এলেন।
ধরুন, আপনি আপনার সন্তানদের ব্যাপারে খুবই সেন্সিটিভ। তারা যখনই কিছু করতে যায়, সাথে সাথে আপনার ব্রেইনের এন্টেনা খাড়া হয়ে যায়। আপনি ভাবতে থাকেন, তারা উল্টা-পাল্টা কিছু করে ফেলছে কি না! আপনি ডিফেন্সিভ হয়ে ওঠেন। আপনি তার সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হয়ে উঠেন। তার দীর্ঘ মেয়াদী বিষয়টি সমাধান না করে আপনি স্বল্পকালীন আচরণ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে গেলেন। আপনি তাকে কঠিন শাষণে ফেলে দিলেন। ফলে দেখতে পেলেন আপনার ছেলেটি বাইরে থেকে খুব ভদ্র এবং শান্ত, কিন্তু ভেতরে ভেতরে সে চরম অবাধ্য, কঠিন রাগকে চেপে রেখেছে যা সুযোগ পেলেই খুব নোংরাভাবে প্রকাশ পাবে। অর্থাৎ আপনি জীবন যুদ্ধে পরাজিত হয়ে গেলেন। ইংরেজিতে যাকে বলে, ইউ আর উংনিং দি ব্যাটল, নট দি ওয়্যার। আপনি ভুলে গেলেন, মনের গভীরে আপনি আপনার সন্তানদের মূল্য দেন, আপনি তাদের ভালোবাসেন, আপনি তাদের সাহায্য করতে চান এবং আপনি নিজেও একজন বাবা হিসেবে নিজেকে মূল্য দিতে চান। আপনার ওই ছেলেটি আপনার মৃত্যুর দিন কী বলতে পারে তা কি দেখতে পারছেন?
আপনি যদি দ্বিতীয় অভ্যাসটি আয়ত্ত্ব করতে চান, তাহলে অন্যের স্ক্রিপ্টকে ফেলে দিন। নিজের জীবনের জন্য নিজেই স্ক্রিপ্ট লিখুন এবং তখন আপনি আপনার মতো করে নতুন স্ক্রিপ্ট সাজিয়ে লিখতে পারবেন। পুরনো স্ক্রিপ্ট ফেলে দেওয়া খুব সহজ নয়। আপনার সাহস লাগবে। সেই সাহস যেদিন সঞ্চয় করতে পারবেন, আপনি এ্যাফেক্টিভ মানুষ হওয়ার পথে পা বাড়াবেন। আপনার ভেতর এক ধরনের ইন্ট্রিগ্রিটি তৈরি হবে। আপনি তৎক্ষণাৎ ইমোশোন দিয়ে পরিচালিত হবেন না, আপনি মূলত ভ্যালু দিয়ে পরিচালিত হবেন।
আপনার কেন্দ্রবিন্দু কোনটি?
ড. স্টিফেন কোভে তার বইতে লিখেছেন, আমাদের জীবনের কেন্দ্রবিন্দুতে যাই থাকুক না কেন, তা পরিচালিত হয় মূলত চারটি বিষয় দিয়ে- আমাদের জীবনের নিরাপত্তা, আপনার জীবনের দিক নির্দেশনা, প্রজ্ঞা এবং ক্ষমতা। এবং এই চারটি বিষয় একে অপরের ওপর নির্ভরশীল। এই চারটি বিষয় যদি আপনার ভেতর খুব ভালোভাবে সমন্বয় করতে পারেন, তাহলে আপনার একটি সুন্দর ব্যক্তিত্ব তৈরি হবে।
আমরা প্রায় সবাই ভিন্ন কিছু কেন্দ্রে বসবাস করি, যা উপরের এই চারটি বিষয়ে প্রভাবিত করে। ড. কোভের মতে, মোটা দাগে আমাদের কেন্দ্রগুলোকে দশটি ভাগে ভাগ করা যায়। চলুন দেখে নেই, আপনার কেন্দ্র কোনটি।
১. স্বামী/স্ত্রী কেন্দ্রিক: আমাদের ভেতর অনেক মানুষ আছেন যারা পরিচালিত হন স্বামী কিংবা স্ত্রী দ্বারা। তাদের সব কিছুর সাথেই তাদের স্বামী কিংবা স্ত্রী জড়িয়ে রয়েছে। সব কিছুর কেন্দ্রে যদি স্বামী/স্ত্রী হয়ে যান, তখন তাদের ভেতর মানসিক টানাপোড়ন আপনার জীবনকে ঝুঁকিপূর্ণ করে তোলে। এই ধরনের কেন্দ্রবিন্দুতে প্রজ্ঞা এবং ক্ষমতা দুটোই বিলুপ্ত হয়।
২. পরিবার কেন্দ্রিক: যারা পরিবার কেন্দ্রিক, তাদের নিরাপত্তা কিংবা ব্যক্তিগত বৈশিষ্টকে ঘিরে থাকে তাদের পারিবারিক ট্রেডিশন নয়তো কালচার। এটা করা যাবে না, ওটা করলে পরিবারের সন্মান নষ্ট হয়ে যাবে, জমিদার বাড়ির ছেলেরা পাড়ার ছেলেদের সাথে খেলতে পারবে না, এমন সব অদ্ভুত বিষয় চলে আসে। ফলে এগুলো যদি কখনও ক্ষতিগ্রস্থ হয়, তখন আপনি পড়েন মহাসাগরে।
৩. টাকা কেন্দ্রিক: অনেকেই আছেন যাদের ধ্যান-জ্ঞান হলো টাকা। তাদের কাছে আর কোনোও কিছুর মূল্য নেই। তারা রীতিমত অন্ধই বলা চলে। কিন্তু তারা বুঝতে পারে না, যেদিন তাদের টাকা থাকবে না, সেদিন তাদের কী অবস্থা হবে! তাদের সন্তানদের শৈশব থাকে না, পরিবারে সদস্যদের সাথে তার যোগাযোগ থাকে না। ফলে তার টাকা সবাই ভোগ করে, কিন্তু তাকে সময় দেওয়ার মতো কেউ থাকে না।
৪. কাজ কেন্দ্রিক: যারা কাজ কেন্দ্রিক মানুষ, তারা একটা সময়ে গিয়ে ওয়ার্কোহলিক হয়ে যান। যেহেতু কাজটাই তাদের পরিচয়, তাই তারা নিজের শরীর এবং মানুষের সাথে সম্পর্ককে উৎসর্গ করে কাজে মেতে থাকেন। কাজ দিয়েই তাদের পরিচয়- যেমন আমি একজন ডাক্তার, আমি একজন লেখক, আমি একজন অভিনেতা ইত্যাদি। তারা মূলত অন্যান্য ক্ষেত্রে খুব একটা এ্যাফেক্টিভ হন না।
৫. দখল কেন্দ্রিক: আমাদের মাঝে অনেকেরই দখল মনোবৃত্তি রয়েছে। তারা ঘর, বাড়ি, গাড়ি, গয়না, দামি জিনিসপত্র ইত্যাদি বিষয়গুলো নিজেদের দখলে রাখার পাশাপাশি অনেকেই আবার নাম, খ্যাতি, সামাজিক প্রতিপত্যি ধরে রাখার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেন। তারা বুঝতেই পারেন না যে, এগুলো যেকোনও সময় হারিয়ে যেতে পারে এবং তখন তারা দিশেহারা হয়ে ওঠে। যেমন স্টক বাজারে কেউ কেউ বিনিয়োগ হারিয়ে আত্মহত্যা করে, কিংবা অন্যকে মেরে ফেলে। বড় বড় সেলিব্রেটিরা অনেক সময় হতাশায় পতিত হন।
৬. বিনোদন কেন্দ্রিক: একদল মানুষ আছে যাদের কাছে বিনোদন ছাড়া আর কিছুই নেই। তারা সবসময়ই বিনোদন চায়। আর সেটা না পেলে তখনই ‘বোর’ হয়ে যায়। কিন্তু বিনোদন হলো এমন একটা বিষয় যা আপনি এই মুহূর্তে পেয়ে সুখি হচ্ছেন, পরের বার আপনার এর চেয়েও বেশি কিছুর প্রয়োজন হয়। আপনি যদি মাত্রারিক্ত ছুটি কাটান, অধিক পরিমাণে সিনেমা দেখেন, অতিরিক্ত টিভি দেখেন, অতিরিক্ত গেম খেলেন, এমন কি নিয়মহীনভাবে অবসর কাটান তাহলে আপনি বিনোদন কেন্দ্রিক মানুষের দলে পড়বেন। এর ফলে আপনার ভেতর অন্য যে ক্ষমতাগুলো ছিল তা আর বিকশিত হওয়ার সুযোগ পাবে না।
৭. বন্ধু কেন্দ্রিক: বন্ধুদের প্রতি অতিরিক্ত নির্ভরতা আপনাকে মানসিকভাবে দুর্বল করে তুলে। তাদের সাথে কোনোও মান-অভিমান আপনার যাবতীয় কর্মকাণ্ডকে প্রভাবিত করতে পারে। আপনার ভালো বন্ধু থাকবে; কিন্তু সেই নির্ভরতা যেন কোনো অবস্থাতেই স্বামী/স্ত্রীর মতো অতিরিক্ত নির্ভরতায় চলে না যায়। সেক্ষেত্রে বন্ধুদের কর্মকাণ্ডের ওপর নির্ভর করে আপনার মুড ওঠানামা করতে পারে।
৮. শত্রু কেন্দ্রিক: অনেক সময়ে আমরা না বুঝেই কাউকে কাউকে এমন শত্রু বানিয়ে ফেলি যে, সেই শত্রুটিই তার অজান্তেই আপনার জীবনকে নিয়ন্ত্রণ করছে। আপনি বুঝতেই পারছেন না যে, আপনি দিন-রাত যা কিছু ভাবছেন, যার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে সেই শত্রুটি। আপনি প্রতিদিন ভাবছেন, এই লোকটি না থাকলেই আপনার জীবন সুন্দর হয়ে যেত। কিংবা এর প্রতিশোধ নেয়ার জন্য আপনি যাবতীয় প্রস্তুতি নিচ্ছেন। অর্থাৎ আপনি আপনার জীবন নিয়ন্ত্রণের যাবতীয় কলকাঠি দিয়ে দিয়েছেন অন্যের উপর। আপনার নিয়ন্ত্রণ আর নিজের কাছে নেই। একইভাবে দেখবেন অনেকেই বিয়ে কিংবা প্রেম ভেঙে দেওয়ার পরও সারাক্ষণ আগের সম্পর্কের কথা বলতে থাকে। আরেকজনকে দোষারোপ করতে থাকে। এরা আসলে তখনও ওই সম্পর্কের ভেতরই রয়ে গেছে।
৯. ধর্ম কেন্দ্রিক: একদল মানুষ আছেন যারা ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি করেন। তারা নিজেদেরকে একটি এক্সট্রিম পর্যায়ে নিয়ে যান এবং অন্যদেরকেও সেই পথে নেওয়ার জন্য চাপ প্রয়োগ করে থাকেন। তাদের স্বাভাবিক জীবন নেই। ধর্ম যে মানুষকে স্বাভাবিক জীবন বিধান দিয়েছে, তারা সেটা থেকে অনেক দূরে অবস্থান করেন।
১০. আত্মকেন্দ্রিক: আমাদের ভেতর সবচে’ বেশি পাওয়া যাবে আত্মকেন্দ্রিক মানুষ। এরা নিজেদের ছাড়া আর কিছুই ভাবতে পারে না। এরা অনেকটা ‘মৃত সাগর’-এর মতো, যা খালি নিতেই জানে, কোনোও কিছুই ফেরত দেয় না। যখনই মানুষ আত্মকেন্দ্রিক হয়ে যায় তখন তার নিরাপত্তা, দিক নির্দেশনা, প্রজ্ঞা এবং ক্ষমতা, সবই খুব ক্ষুদ্র হয়ে যায়।
দেখে নিন, আপনার কেন্দ্র কোনটি!
নীতি কেন্দ্রিক
আগের সেকশনে যে দশটি কেন্দ্রের কথা বলা হলো, এর সবগুলোই ঝুঁকিপূর্ণ। আপনি যে কেন্দ্রিকই হোন না কেন, আপনি খুব বেশি এ্যাফেক্টিভ হতে পারবেন না। কারণ সবগুলো কেন্দ্রই ভালনারেবল। তাই আমাদের কেন্দ্র হওয়া উচিৎ নীতি কেন্দ্রিক। এই গ্রহের নীতি যেমন পরিবর্তন হয় না, তেমনি আপনি যদি নীতি ঠিক করে নিতে পারেন এবং সেগুলো অনুসরণ করতে পারেন তাহলে আপনি আরও বেশি এ্যাফেক্টিভ হতে পারেন।
একটি উদাহরণ দিলে বিষয়টি বুঝতে সুবিধা হতে পারে। ধরুন আপনি স্ত্রীকে নিয়ে ক্রিকেট খেলা দেখতে যাবেন। টিকিট আছে। সব প্রস্তুত। কিন্তু সকাল বেলা অফিস থেকে বস ফোন করে বললেন, তিনি এখনও তার কাজ শেষ করতে পারেননি। কাল তো প্রেজেন্টেশন। আপনি গিয়ে একটু সহায়তা করতে পারেন কি না?
বসের এমন ফোনে আপনি কী আচরণ করবেন?
আপনি যদি স্ত্রী কেন্দ্রিক হন, তাহলে আপনি বসের কথা অবজ্ঞা করে স্ত্রীকে নিয়ে খেলা দেখতে চলে যাবেন। অফিসের সমস্যা হলে আপনার কী, তাই না?
আপনি যদি কাজ কেন্দ্রিক হন, তাহলে স্ত্রীকে কিছু না বলেই আপনি অফিসে চলে যাবেন। স্ত্রী মনে কষ্ট পেয়েছে, সেটা নিয়ে আপনি বিব্রত হবেন না।
আপনি যদি টাকা কেন্দ্রিক হন, তাহলে এই কাজটি করে আরেকটু বেশি টাকা পেতে পারেন, কিংবা বসের একটু নেক নজরে থাকতে পারেন, পরের বার প্রমোশনটা আপনার হতে পারে ইত্যাদি ভেবে আপনি অফিসে যাবেন। আপনি যদি বন্ধু কেন্দ্রিক হন নয়তো বিনোদন কেন্দ্রিক, তাহলে হয়তো দেখতে পাবেন আপনার কিছু বন্ধু খেলা দেখতে যাচ্ছে, তাই আপনিও সেটা মিস করতে চাইবেন না। আপনার সিদ্ধান্তগুলো কিন্তু এভাবেই ঘুরপাক খাবে।
কিন্তু আপনি যদি নীতি কেন্দ্রিক হতেন, তাহলে আপনাকে ভিন্ন বিষয় তাড়িত করত। আপনার নীতিতে হয়তো আছে, সহকর্মীকে সহায়তা করা। কিংবা অফিসের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আপনার ভূমিকা রাখা। এর সাথে আর কোনোও কিছুর সম্পর্ক নেই। আপনি অফিসে যদি যান, তাহলে আপনার যাওয়াটা হবে ভিন্ন। আর যদি যেতে না পারেন, সেটারও এটিচিউড হবে ভিন্ন। আপনি হয়তো বসকে বলবেন, তুমি আমাকে পুরোটা ই-মেইল করে দাও, আমি মাঠে খেলা দেখে এসে রাতে করে রাখব। তারপর খুব ভোরে ওঠেই আপনি অফিসে গিয়ে বাকি কাজগুলো দেখতে থাকবেন। নীতি কেন্দ্রিক হলে, আপনার সিদ্ধান্ত ভিন্ন হবে।
আপনি যখন নিশ্চিত হয়ে যাবেন, আপনার সিদ্ধান্ত ওই দশটি কেন্দ্র দিয়ে ত্বাড়িত নয়, বরং নীতি দিয়ে ত্বাড়িত তখন আপনি হয়ে উঠবেন সবচে’ এ্যাফেক্টিভ মানুষ। আপনি হবেন পরবর্তী নেতা। প্রতিষ্ঠান আপনার ওপরই নির্ভর করতে থাকবে। আপনাকে কেন্দ্র করেই ঘটতে থাকবে সবকিছু।
মাথার দুটি অংশই ব্যবহার করুন
মানুষের মাথার দুটি অংশ- বাম দিক এবং ডান দিক। অনেক গবেষণায় এটা প্রমাণিত হয়েছে। ব্রেইনের দুই অংশ দুই ধরনের কাজের জন্য পারদর্শী।
বাম দিকের ব্রেইন হলো যুক্তিবাদী এবং সরাসরি যা দেখা যায় সেগুলো নিয়ে কাজ করে। অপরদিকে ডান দিকের ব্রেইন হলো ক্রিয়েটিভ এবং স্বজ্ঞাত (ইনটিউটিভ)। বাম দিকের ব্রেইন সিকোয়েন্সিয়াল চিন্তা করতে পারে, কিন্তু ডান দিকের ব্রেইন হোলিস্টিক চিন্তা করতে পারে। ক্রিয়েটিভ মানুষদের ডান দিকের ব্রেইন বেশি সক্রিয়।
এবং মানুষের ধর্ম হলো, যে যেটাতে পারদর্শী সেটা নিয়ে থাকতে চায়। একটু ভিন্ন কথায় যদি বলি, যে মানুষটা ভালো হাতুরি চালাতে পারে তার কাছে পৃথিবীর সবকিছুই প্যারেকের মতো। তিনি সেই হাতুরি দিয়েই সেটা সমাধান করতে চান। এই পৃথিবীর বেশিরভাগ মানুষ পরিচালিত হয় বাম দিকের ব্রেইন দিয়ে। তাই আমাদের মাঝে কবি, সাহিত্যিক, শিল্পী, উদ্ভাবকের সংখ্যা কম। এরা পরিচালিত হয় ডান দিকের ব্রেইন দিয়ে। আপনি যদি এ্যাফেক্টিভ হতে চান তাহলে দুটি ব্রেইনকেই ব্যবহার করতে হবে।
ব্রেইনের দুটো পাশকেই ব্যবহার করার অনেক টেকনিক বের হয়েছে। সেগুলো নিয়ে পরবর্তীতে কখনও লেখা যাবে। তবে এখন থেকে যে কাজেই হাত দেবেন, তার শেষটা আগে নিজের ভেতর দেখে নেবেন। তারপর কাজে নামবেন। দেখবেন অনেক পরিবর্তন লক্ষ্য করছেন।
No comments