আমার দিন: অভ্যাস ৩ ॥ প্রথম জিনিসকে প্রথমেই রাখুন!::জাকারিয়া স্বপন

আপনাদের জীবনে এমন কখনও হয়েছে যে, আপনি কারও সাথে দেখা করতে গিয়েছেন; আর সেই মানুষটি আপনার সামনেই একটার পর একটা ফোনে কথা বলে যাচ্ছে? কখনও ইন্টারকমে, কখনও মোবাইলে? আর আপনি তার সামনে বসে বসে মাছি মারছেন।
জ্বি, আমার জীবনে অসংখ্য বার এমন হয়েছে। কিছুদিন আগেই যেটা হলো, তার কাহিনীটা বলি। একটি প্রাইভেট ব্যাংকের ডিএমডি সাহেবের কাছে আমাকে যেতে বললেন ব্যাংকটির একজন ডিরেক্টর। আমি কোনোও ব্যাংক ঋণের জন্য যাইনি। গিয়েছিলাম একটি উইন-উইন প্রস্তাব নিয়ে, যা ব্যাংকটির পরিচালনা পরিষদ এপ্রোভ করেছে।
একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা আমাকে লবি থেকে উক্ত ভদ্রলোকের কক্ষে নিয়ে গেলেন। পরিচয় করিয়ে দিলেন। এবং আমি এমন নয় যে হুট করেই চলে গিয়েছি। রীতিমতো সময় ঠিক করেই গিয়েছি। ভদ্রলোক আমার সাথে হ্যালো বলে তার ঘরের সোফায় বসতে বললেন। আমি ভাবলাম, তিনি হাতের কাজটি শেষ করেই আমার সাথে কথা বলে আমাকে বিদায় করে দিবেন। তাতে দু'জনেরই সময়টা বেঁচে যায়।
নাহ, তিনি সেটা করলেন না। তিনি কিছুক্ষণ ইন্টারকমে একজনের সাথে দীর্ঘক্ষণ কথা বললেন, যার বেশির ভাগই হলো খোসগল্প। তারপর কেউ একজন কিছু ফাইল সই করাতে এলেন। তিনি তাকেও দাঁড় করিয়ে রেখে ফোনে আলাপ করছেন। তারপর সেটা ক্ষান্ত দিয়ে যেই মুহূর্তে সই করার কাগজ দেখতে শুরু করলেন, তখন তার মোবাইলটা বেজে উঠল। তিনি আগের মতোই আবার দীর্ঘ আলাপে লেগে গেলেন। এরপর তার ঘরে আরও দু'জন অফিসারকে ডেকে নিয়ে এলেন। তারা আমার বিষয়টি তাকে বুঝিয়ে বলবেন। কিন্তু সেই আলোচনায় যাবার আগে তিনি আবারও আড্ডায় মাতলেন। এবারে তিনি ছোট একটি অঙ্ক করতে বসলেন। ১৯৮৫ সালে তিনি যদি একটি ব্যাংকে ১০০ টাকা জমা রাখতেন, তাহলে আজকে সেটা নাকি এক কোটি টাকার বেশি হতো। তিনি প্রথমেই ক্যালকুলেটর দিয়ে হিসাব করছেন। তাতে হলো না। তারপর সাদা কাগজে বছরের পর বছর লিখে সেটা মেলানোর চেষ্টা করছেন। এবং সেই দু'জন উচ্চ পদস্থ অফিসার ‘জ্বি ‌স্যার, জ্বি স্যার’ করে তাকে উৎসাহ দিয়ে যাচ্ছেন।
আমি বেশ কয়েকবার চলে আসার জন্য উঠে দাঁড়ালাম। তিনি বারবার আরেক কাপ চা খাওয়ার জন্য বলতে থাকেন। আমি ভেতরে ভেতরে চরম বিরক্ত। একজন মুরুব্বি মানুষ তার কাছে পাঠিয়েছিলেন। তার সন্মানার্থে তেমন কিছু বলতে পারছি না। এর ভেতর তিনি আরও দশটা ফোনকল শেষ করলেন। একটা পর্যায়ে ভদ্রভাবেই বললাম, আমার এখন যেতে হবে।
আমি মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম, এই ধরনের প্রতিষ্ঠানের সাথে আমার পক্ষে কাজ করা অসম্ভব।
কিছুদিন পর, কোনোও একটি কারণে সেই ব্যাংকের ম্যানেজিং ডিরেক্টরের একটি কাজ পড়ল আমার কাছে। আমি তার কাজটি কয়েক মিনিটের ভেতর করে দিয়ে বললাম, ‘আমি চাইলে আপনাকে কয়েক দিন ঘুরাতে পারতাম। কিন্তু সেটা আমার নীতি নয়। আপনি আপনার ডিএমডি লোকটাকে দ্রুত সরান’। আমরা অনেক সময়ই বুঝতে পারি না, কোন কাজটির পর কোন কাজটি করা দরকার। বিশেষ করে টেলিফোন এলে সেটাকে আমরা সবাই প্রথম গুরুত্ব দেই। আমাদের দেশে খুব কম মানুষ আছেন, যারা টেলিফোনটি বাজতে দিতে দেখতে পারেন। তারা আপনাকে বসিয়ে রেখেই ফোনটি ধরবেন। আপনি যে এত কষ্ট করে ট্রাফিক জ্যাম ঠেলে তার কাছে গিয়েছেন, তার থেকেও মূল্যবান হয়ে ওঠে টেলিফোন। এটা ঠিক নয়। বিশেষ করে জাপানে আপনি যদি মিটিংয়ের ভেতর ফোন ধরেন, ওখানকার মানুষ এটাতে এত বেশি বিরক্ত হয় যে আপনাকে পরের মিটিংয়ে নাও ডাকতে পারে।
গত সপ্তাহে লিখেছিলাম, এই পৃথিবীর এ্যাফেক্টিভ মানুষদের অভ্যাসগুলোর দ্বিতীয়টি নিয়ে, যার শিরোনাম ছিল ‘ শুরুটা করুন শেষ থেকে ’। ড. স্টিফেন কোভে-এর লেখা ‘দি সেভেন হ্যাবিট অফ হাইলি এ্যাফেক্টিভ পিপল’ বইটির তৃতীয় অভ্যাস হিসেবে বলা হয়েছে, প্রথম বিষয়টিকে প্রথমেই রাখতে। ওই বইয়ের প্রথম অভ্যাসটিতে বলা হয়েছে, আপনি হলেন আপনার পরিচালক। আর দ্বিতীয় অভ্যাসে বলা হয়েছে, আপনার কাজের ধারাটির প্রথম তৈরি হয় আপনার মনে। আর তৃতীয় অভ্যাস হলো, সেই পরিকল্পনাকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার প্রক্রিয়া।
ব্যক্তিগত ব্যবস্থাপনা
আচ্ছা, প্রথমেই আপনাকে দুটি প্রশ্ন করি। ভেবে চিন্তে উত্তর দিন।
প্রশ্ন-১: এমন একটি কাজের কথা কি আপনি বলতে পারেন, যা আপনি এখন করেন না কিন্তু যদি প্রতিদিন করতেন তাহলে আপনার ব্যক্তিগত জীবনে বিশাল কোনোও পরিবর্তন আনত?
প্রশ্ন-২: এমন একটি কাজের কথা কি আপনি বলতে পারেন, যা আপনি এখন করেন না কিন্তু যদি প্রতিদিন করতেন তাহলে আপনার প্রফেশনাল জীবনে ইতিবাচক কোনোও পরিবর্তন আনত?
আমরা আগের চ্যাপ্টারে বলেছিলাম, প্রতিটি জিনিসের দুইবার জন্ম হয়। একবার হয় আপনার মাথায় এবং দ্বিতীয়বার হয় বাস্তবে। আগের অভ্যাসটি হলো, আপনি মাথায় সঠিকভাবে পরিকল্পনাটা করে নিয়েছেন। এবার হলো সেটাকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার পালা, দ্বিতীয়বার তৈরির কাজ। এবং সেটা হলো তৃতীয় অভ্যাস। আপনার স্বপ্নকে বাস্তবে পরিণত করার কাজটিই আপনি করবেন এই অভ্যাসের মাধ্যমে। তবে তার সঠিক নিয়ম-কানুন রয়েছে। এর জন্য চাই সঠিক ব্যক্তিগত ব্যবস্থাপনা। আপনি যদি নিজেকেই নিয়ন্ত্রণ করতে না পারেন, তাহলে আপনি এলোমেলো হয়ে যাবেন। এবং বাস্তবে কাজটিও সঠিকভাবে হবে না।
আপনাকে জানতে হবে, কীভাবে প্রথম জিনিসটাকে প্রথমেই রাখতে হয়। কিছুদিন আগে আমার একজন সহকর্মী খুব আগ্রহ নিয়ে বলল, ভাইয়া, এই কাজটা করে ফেলি? আমি তার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বললাম, ‘বাচ্চা নেওয়ার আগে বিয়েটা করে নাও’।
এবং এটা করার মতো নিয়মানুবর্তিতা আপনাকে শিখে ফেলতে হবে। কিছু নিয়ম-নীতির নিয়মানুবর্তিতা, কিছু ভ্যালুর নিয়মানুবর্তিতা, নিজের নিয়মানুবর্তিতা এবং নিজের কাছে নিজের প্রতিশ্রুতি যদি শক্তিশালী হয়, আপনার তৃতীয় অভ্যাসটি গড়ে উঠতে সহজ হবে। আমি যখন তরুণ বয়সী কোনোও মোটা ছেলে কিংবা মেয়ে দেখি, প্রথমেই ধরে নেই নিজের প্রতি তার প্রতিশ্রুতি খুবই দুর্বল (যদি না তার কোনোও অসুখ থেকে থাকে)। এই ছেলে বা মেয়েকে দিয়ে তেমন কিছু হবে না। তার মানসিক শক্তি খুবই কম। সে অন্যের ওপর ভর করেই জীবন চালাতে পছন্দ করবে।
এই পৃথিবীতে যত সফল মানুষ আছে, তাদের সবার ভেতর একটি জিনিস কমন। বলুন তো সেটা কী? তাদের কঠোর পরিশ্রম? তাদের ভাগ্য? তাদের কানেকশন? যদিও এগুলোর প্রয়োজন রয়েছে, কিন্তু এর কোনোটাই আসলে তাদের সবার জন্য কমন নয়। প্রতিটি সফল মানুষের মাঝে কমন বিষয়টি হলো ‘অভ্যাস ৩’, আগের জিনিসটাকে আগে বসাতে পারার ক্ষমতা। (সূত্র: দি কমন ডিনোমিনেটর অফ সাক্সেস, লিখেছেন ই. এম. গ্রে)
আপনার নিজের ভেতর যদি কোনোও বিষয়ে পরিষ্কার পরিকল্পনা না থাকে, তাহলে আপনি সেটাকে বাস্তবে রূপ দিতে গিয়েও ব্যর্থ হবেন। আর যখন সেই পরিকল্পনাটা পরিষ্কার থাকবে, তখন আপনি অসংখ্য বিষয়কে ‘না’ বলে দিয়ে নিজের লক্ষ্যে এগিয়ে যেতে পারবেন। নইলে, যাবতীয় পারিপার্শ্বিক বিষয়গুলো আপনাকে ভিন্ন পথে টেনে নিয়ে যাবে। তাই আপনার সময়টাকেও সঠিকভাবে ব্যবস্থাপনায় আনতে হবে।
সময়ের ব্যবস্থাপনা
এই গ্রহের সবার জন্যই ২৪ ঘণ্টায় দিন, সাত দিনে সপ্তাহ এবং ৫২ সপ্তাহে বৎসর। এর থেকে কেউ কম পান না, কেউ বেশিও পান না। তারপরেও একেকজনের এফেক্টিভনেস একেক রকম হয় কেন?
এই গ্রহের বেশিরভাগ মানুষ তাদের সময়কে সঠিকভাবে ব্যবহার করতে পারেন না। তারা মনে করেন, তাদের হাতে অফুরন্ত সময় রয়েছে। সেই সময়ের ভাণ্ডার থেকে ইচ্ছে মতো সময়ে এনে খরচ করলেই হলো। তাদের কাছে প্রায়োরিটি কিংবা এ্যাফেক্টিভ বলে কিছু নেই। যারা এই দলে আছেন এবং আমার এই লেখাটি এখন পর্যন্ত পড়ছেন, তাদেরকে নীচের অংশটুকু খুব মন দিয়ে পড়তে বলব।
আমাদের জীবনে মূলত দুই ধরনের ঘটনা ঘটে- জরুরি এবং গুরুত্বপূর্ণ। অর্থাৎ কিছু বিষয় থাকে যেগুলো জরুরি কিংবা জরুরি নয়। অপরদিকে এমন কিছু বিষয় থাকে যেগুলো গুরুত্বপূর্ণ কিংবা গুরুত্বহীন। অর্থাৎ জরুরি বিষয়ও গুরুত্বপূর্ণ কিংবা গুরুত্বহীন হতে পারে। আবার অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ও জরুরি কিংবা অজরুরি হতে পারে।
এটুকু পড়ে অনেকেই একটু বিভ্রান্ত হতে পারেন। সবাই মনে করছেন, জরুরি বিষয় আবার গুরুত্বহীন হয় কীভাবে? কিংবা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আবার অজরুরি হয় কীভাবে? পুরো বিষয়গুলোকে চারটি ঘরে বসানোর চেষ্টা করুন। তারপর আমি ব্যাখ্যা করছি। আমরা যদি একদিকে জরুরি/অজরুরি বিষয়গুলোকে লিখি এবং অন্যদিকে গুরুত্বপূর্ণ এবং গুরুত্বহীন বিষয়গুলোকে লিখি, তাহলে উপরের প্রথম ঘরে আছে জরুরি এবং গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, তার ডানদিকের ঘরে আছে গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু অজরুরি বিষয়। এবারে নীচের দুটি ঘরের প্রথমটিতে (তৃতীয় ঘর) আছে গুরুত্বহীন কিন্তু জরুরি বিষয় এবং চতুর্থ ঘরে আছে গুরুত্বহীন ও অজরুরি বিষয়। একটু কাগজ কলম নিয়ে চারটি ঘর এঁকে ফেললেই বুঝতে পারবেন।
মিলিয়ে নিন চার্টটির সঙ্গে
জরুরি বিষয় মানে হলো যেগুলো এক্ষুণি করতে হবে। কারো হার্ট এ্যাটাক করেছে- এটা জরুরি। তাই হাসপাতালে জরুরি বিভাগ থাকে। একইভাবে একটি ফোন যখন তার স্বরে চিৎকার করে বাজতে থাকে, তখন সেটা জরুরি। তবে সেটা গুরুত্বপূর্ণ নাও হতে পারে। আমাদের দিনের বেশির ভাগ ফোন কলই দেখবেন গুরুত্বপূর্ণ নয়। আপনি কাউকে ফোন করে কতবার শুনতে পান যে, একটু অপেক্ষা করুন, আমি আপনাকে পরে ফোন দিচ্ছি? বেশিরভাগ মানুষই ফোনে কথা বলতে থাকেন।
জরুরি বিষয়গুলোকে আমরা চোখে দেখতে পাই। এই বিষয়গুলো আমাদের ঘাড়ে চেপে আসে। তারা চাপ তৈরি করে। এক্ষুণি শেষ করার তাড়া থাকে। সাধারণত এগুলো অন্যদের জন্য জনপ্রিয় হয়ে থাকে। তারা সাধারণত আমাদের সামনে এসে হাজির হয়। এবং বেশিরভাগ সময়ই এগুলো সহজ, করতে মজা আছে এবং আনন্দময়। অবাক হচ্ছেন? এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এগুলো গুরুত্বহীন।
অপরদিকে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো ফলাফল নির্ভর। যে জিনিসটাই গুরুত্বপূর্ণ, দেখবেন তার একটি ফলাফল থাকে। আমরা অনেক ক্ষেত্রেই জরুরি বিষয়কে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বলে গুলিয়ে ফেলি। যদি কোনোও কিছু গুরুত্বপূর্ণ হয়, তখন সেটা আপনার স্বপ্নকে, মিশনকে বাস্তবায়নে সাহায্য করবে, আপনার ভ্যালু তৈরিতে সাহায্য করবে, আপনার যে লক্ষ্য আছে সেখানে যেতে সাহায্য করবে। এর বাইরে যা, তা সবই আপনার জন্য গুরুত্বহীন। যেমন প্রতি মুহূর্তে সংবাদ দেখা কিংবা সামাজিক মাধ্যমে স্ট্যাটাস দেখা আপনার জন্য গুরুত্বপূর্ণ নয়, কারণ মিডিয়া আপনার কাজ নয়। যারা মিডিয়াতে কাজ করেন, তাদের জন্য আবার বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো আপনার ‘সার্কেল অফ ইনফ্লুয়েন্স’-এর ভেতর থাকবে।
আমাদের অনেকের কাছেই কোনটা গুরুত্বপূর্ণ, সেটা নির্ণয় করা কঠিন হয়ে ওঠে।
সময় ব্যয় করুন দ্বিতীয় ঘরে
আপনি যাচ্ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাসে। গুরুত্বপূর্ণ ক্লাস। আপনার পছন্দের বিষয় এবং আপনি এই বিষয়টিতেই ভালো কিছু করতে চান। এই ক্লাসটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ, এটা আপনার জীবনের লক্ষ্যের পথে সাজানো। কিন্তু রাস্তা দিয়ে যখন হেঁটে যাচ্ছিলেন, তখন মোবাইল ফোনে এক বন্ধু জানাল, এক্ষুণি ক্যান্টিনে চলে আয়, মিতু এসেছে।
বন্ধুর ফোন কলে এবং মিতুর উপস্থিতিতে ক্যান্টিন হয়ে গেল আপনার কাছে গুরুত্বপূর্ণ। আপনি ক্লাসে না গিয়ে চলে গেলেন ক্যান্টিনে। এই ধরনের ঘটনা কি আপনার জীবন ঘটছে না প্রতিনিয়ত? যদি তাই হয়, তাহলে আপনি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি ধরতে পারছেন না। জরুরি বিষয়গুলো আপনার পুরো সময় খেয়ে ফেলছে। আপনি সময়কে সঠিকভাবে ব্যবহার করতে পারছেন না।
চলুন কিছুটা বুঝার জন্য প্রতিটি ঘরের কিছু উদাহরণ এবং ফলাফল দেই। তাহলে হয়তো বুঝতে সুবিধা হতে পারে।
এক. গুরুত্বপূর্ণ এবং জরুরি
এই ধরনের কাজের ভেতর বেশি থাকে হলো ক্রাইসিস। যেমন ধরুন আগুন লেগেছে, কিংবা ভূমিকম্প, নয়তো ইন্টারনেট লিংক ডাউন এক্ষুণি ঠিক করতে হবে, এসির পানিতে ঘরে ভেসে গেছে, আপনার ছেলে কারও সাথে মারামারি করে এসেছে ইত্যাদি। এর সাথে এমন ধরনের কাজ থাকতে পারে যেগুলোর জন্য চাপ আছে। যেমন আপনার বস এসে বলল, এই কাজটি এখনই করে দিতে হবে; নয়তো আপনার স্ত্রী ফোন করে বলল- এখনই বাজারে না গেলে মাছ পাওয়া যাবে না ইত্যাদি। এবং পাশাপাশি যে সকল প্রজেক্ট সময় নির্ভর, তারাও এই ঘরে পড়বে। এই ঘরের কাজগুলোকে আপনি এড়িয়ে যেতে পারবেন না। এগুলো করতেই হবে।
তবে সারাদিন যদি এগুলোই করতে থাকেন, তাহলে আপনি শেষ। আপনি যদি এই ঘরে বেশি সময় ব্যয় করেন, তাহলে আপনি একটি স্ট্র্যাসফুল জীবন-যাপন করবেন এবং একটা সময়ে বার্ন-আউট হয়ে যাবেন। কিছু কাজ অন্যকে ডেলিগেট করে দিতে শিখতে শিখুন এবং দ্বিতীয় ঘরে সময় ব্যয় করার ব্যবস্থা করুন।
দুই. গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু জরুরি নয়
এই ঘরটাতেই সবচে’ বেশি সময় দিবেন আপনি। যেহেতু বিষয়গুলো জরুরি নয়, তাই আমরা বেশি সময় ব্যয় করি না, হালকাভাবে নেই। কিন্তু যদি তৃতীয় অভ্যাসটি গড়তে চান, তহালে এটাই হবে আপনার সবচে’ বড় পরিবর্তন। কোন কাজগুলো আসলে জরুরি নয়, কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ? একটি বড় ধরনের কাজের উদাহরণ হলো ‘প্রতিরোধ’। অর্থাৎ আপনি এমনভাবে সময় ব্যয় করুন, যেমন কোনোও সমস্যার বা ক্রাইসিসের জন্মই না হয়। সমস্যা হলে তো সমাধান করবেনই। কিন্তু আপনি নিজেই যেন সমস্যার জন্ম না দেন। মাথায় যদি থাকে ‘প্রতিরোধ’ তাহলে আপনি আগে-ভাগেই সঠিক কাজগুলো শেষ করে ফেলবেন। তারপর হলো সেই কাজগুলো করা, যেগুলো আপনাকে ‘প্রডাকশন ক্যাপাসিটি’ তৈরিতে সহায়তা করে। যেমন ধরুন, আপনার শরীরকে ঠিক রাখা। শরীর ঠিক না থাকলে আপনি প্রডাকশন দিবেন কীভাবে? একইভাবে, যেই যন্ত্রটি ব্যবহার করছেন তার মেইন্টেনেন্স করা, যেন সেটা প্রডাকশন দিতে সমর্থ থাকে।
এই ঘরের আরেকটি কাজ হলো সম্পর্ক তৈরি করা। অনেকেই সম্পর্ক তৈরিতে কোনোও সময় ব্যয় করতে চায় না। এটাতে সময় ব্যয় করাকে নষ্ট খাত হিসেবে ধরে নেয়। কিন্তু এটা দ্বিতীয় ঘরের একটি বড় ক্ষেত্র। আরও যে কাজগুলো রয়েছে তা হলো- নতুন সম্ভাবনাকে রিকগনাইজ করা, সঠিক পরিকল্পনা করা, সঠিক চিত্তবিনোদন করা ইত্যাদি।
এই ঘরে সময় বেশি দেওয়ার ফলাফল হিসেবে আপনার ভিশন এবং দৃষ্টিভঙ্গি অনেক সুন্দর হবে, আপনার জীবন ব্যালেন্স হবে, আপনার সবকিছু নিয়মের ভেতর চলে আসবে, আপনি অনেক কিছুই নিয়ন্ত্রণ করতে শিখে ফেলবেন এবং জীবনে কম ক্রাইসিসে পড়বেন।
তিন. গুরুত্বহীন কিন্তু জরুরি
আমাদের জীবনে অনেক জরুরি বিষয় ঘটে যেগুলো আসলে গুরুত্বহীন। এর একটি বড় উদাহরণ হলো ‘প্রতিবন্ধক’ (ইন্টারাপ্ট)। অর্থাৎ আপনি কোনোও কিছুতে মগ্ন ছিলেন, কিন্তু হঠাৎ করেই কেউ হৈচৈ শুরু করে দিল। আপনার মগ্নতা কেটে গেল। আপনার কাজের মান কমে গেল। আরও কিছু উদাহরণ যেমন- কিছু কিছু ফোন কল, কিছু কিছু ই-মেইল, কিছু কিছু মিটিং, যে বিষয়গুলো আপনাকে চাপ দিচ্ছে, জনপ্রিয় কর্মকাণ্ড ইত্যাদি।
কোনোও বন্ধু অফিসের কাজের সময় ফোন দিল। ফোনটি যদি সাথে সাথে ধরেন, তাহলে সেটা জরুরি হয়ে গেল। আপনি ওটাকে জরুরি করে ফেললেন। কিন্তু সেই ফোনটি গুরুত্বপূর্ণ না। আপনি প্রশ্ন করতে পারেন, কেন ফোনটি তো গুরুত্বপূর্ণও হতে পারে। যে ফোনগুলো গুরুত্বপূর্ণ সেগুলো আপনি বুঝতে পারবেন। সেগুলো এমনিতেই এক নম্বর ঘরে চলে যাবে।
এভাবে দেখবেন সারাদিন আপনি কত ই-মেইল, মিটিং এবং ফোনে সময় ব্যয় করছেন যেগুলো গুরুত্বহীন।
আপনি যদি এই ঘরে সময় বেশি ব্যয় করেন তাহলে ফলাফল হিসেবে পাবেন, স্বল্প মেয়াদী পরিকল্পনা, ক্রাইসিস ম্যানেজ করতেই থাকবেন, লক্ষ্য ঠিক করে এগিয়ে যাওয়াটাকে গুরুত্বহীন মনে হবে, প্রায়ই মনে করবেন আপনি পরিস্থিতির শিকার হয়েছেন, নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ থাকবে না এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রে খুব হালকা ধরনের সম্পর্ক তৈরি হবে যেগুলো টিকবে না।
চার. গুরুত্বহীন এবং জরুরি নয়
অনেকেই নিশ্চয়ই ভাবছেন, আমি একজন কর্মব্যস্ত মানুষ, আমার কাছে কি গুরুত্বহীন এবং অজরুরি কিছু আসতে পারে? বিশ্বাস করবেন, এই গ্রহের বেশিরভাগ মানুষ এই চতুর্থ ঘরেই সময় কাটায় বেশি। মানুষ তুচ্ছ বিষয়ে সময় কাটায় বেশি। সারাদিন দেখবেন প্রচণ্ড ব্যস্ত। কিন্তু কোনোটাই গুরুত্বপূর্ণ নয়। অনেকেই ই-মেইলে, ম্যাসেঞ্জারে এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে লম্বা সময় কাটান। এগুলো কি আপনার জন্য গুরুত্বপূর্ণ?
অনেকেই মনে করেন, সারাক্ষণ ফেসবুক কিংবা অনলাইনে থাকাটা গুরুত্বপূর্ণ। আসলেই কি তাই? এগুলো হলো আপনার জন্য সবচে’ বড় ইন্টারাপ্ট। আপনি দিনের একটি সময় ঠিক করে নিন যখন নিউজ পড়বেন, নয়তো ফেসবুক দেখবেন। ওই ত্রিশ মিনিটই আপনার বরাদ্দ। এটা কিন্তু বিনোদন না, আবার আপনার জীবনের লক্ষ্যের সাথেও যায় না। এর সাথে যুক্ত হতে পারে অসংখ্য বিষয়, যেগুলো আপনার মূল্যবান সময়কে নষ্ট করে। যেমন বাঙালিদের একটি হলো আড্ডা। বাঙালি একটু সুযোগ পেলেই আড্ডা দিয়ে ফেলবে। এমন-কি সেটা পুরো অফিসের ভেতর বসেই। এতটুকু লজ্জা অনুভব করবে না।
আপনি যদি তিন এবং চার- এই দুটি ঘরে বেশি সময় ব্যয় করে থাকেন, তাহলে বুঝতে হবে আপনি পুরোপুরি দায়িত্বজ্ঞানহীন জীবন-যাপন করছেন। এরা মূলত চাকরিচ্যুত হয় এবং ন্যূনতম জীবনযাপনের জন্য অন্যের ওপর (পরিবার কিংবা প্রতিষ্ঠান) নির্ভরশীল হয়।
পরনির্ভরশীল জীবন!
আমি বাংলাদেশকে যতটুকু চিনি, এর বিশাল বড় একটি গোষ্ঠি দায়িত্বজ্ঞানহীন জীবন-যাপন করে। তারা পরনির্ভরশীলতাকে বেছে নিয়েছে এই বলে যে, তারা সঠিক সুযোগ পায়নি। একটি পরিবারে অনেককে দেখবেন, তারা কোনোও কাজ করবে না। মা-বাবা কিংবা ভাই-বোনের উপার্জনে তারা চলে। এবং তারা বিশ্বাস করে, ভাই-বোনের আয়ে তো তারা চলতে পারে। আমি চোখ বন্ধ করলেই এমন অসংখ্য পরিবার দেখতে পাই, যেখানে একজন বা দু’জন কষ্ট করে আয় করছেন, বাকিরা মহাআনন্দে সেটা ভোগ করছেন। এবং তাতে তাদের বিন্দুমাত্র লজ্জা-শরম নেই।
এরা স্বেচ্ছায় পরনির্ভরশীল। আবার আমাদের মাঝে অসংখ্য মানুষ আছেন যারা পরিবারের ওপর নয়, প্রতিষ্ঠানের ওপর নির্ভরশীল। এরা অফিসে কাজটি সঠিকভাবে করে না। নানান ধরনের জনপ্রিয় কাজে সময়টা ব্যয় করে এবং মাসের শেষে বেতনটুকু নিয়ে আনন্দে জীবন-যাপন করে। এবং খেয়াল করে দেখবেন, এরাই প্রতিষ্ঠানে সবচে’ বেশি অভিযোগ করে। এর মূল কারণ, তারা দায়িত্বজ্ঞানহীন জীবন-যাপনে অভ্যস্ত। তারা বিশ্বাস করে, চাকরি তো করছি একটা; কোম্পানি বেতন দিবে, ব্যস।
আমার ধারণা, যারা দায়িত্বজ্ঞানহীন জীবন-যাপন করেন, তারা আমার এই লেখাটি পড়বেন না; এবং কেউ কেউ পড়লেও ‘অনেক দেখছি’ বলে উড়িয়ে দেবেন। এবং আমি তাদের জন্য আমার মূল্যবান সময় ব্যয় করে লিখছিও না। আমি লিখছি তাদের জন্য, যারা নিজেদেরকে আরও বেশি এ্যাফেক্টিভ হিসেবে দেখতে চান।
তাদের জন্য এবারে বলছি- লেখার প্রথমেই দুটো প্রশ্ন করে রেখেছিলাম, এমন কি কাজ আপনি করছেন না, কিন্তু প্রতিনিয়ত করলে আপনার জীবনে ইতিবাচক প্রভাব ফেলত? এবারে নতুন করে ভেবে উত্তরটুকু দিন। নিজের কাছে নিজেই উত্তর দিন। দেখুন, সেগুলো দ্বিতীয় ঘরের বিষয়বস্তু কি না! আমার ধারণা, সেগুলো দ্বিতীয় ঘরের বিষয়াদি, যা আপনার জীবনকে দীর্ঘমেয়াদী তৈরিতে সাহায্য করবে।
গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু জরুরি নয়- এমন খাতে সবচে’ বেশি সময় ব্যয় করুন।
(চলবে)

No comments

Featured post

একনায়িকাতন্ত্র

আমার বুকের ভেতরের "মন" নামক রাষ্ট্রে ভালোবাসার অজুহাতে যে স্বৈরাচারী শাসন ব্যবস্থা চলছে, তার নাম একনায়িকাতন্ত্র। নায়িকার ইচ্ছেমতো...

Powered by Blogger.