আমার দিন: অভ্যাস ৪ ॥ উইন/উইন মানসিকতা::জাকারিয়া স্বপন

কয়েক বছর আগে বুয়েটে আমার খুব প্রিয় একজন শিক্ষক ফোন করে বললেন, স্বপন আমি তো খুব বিপদে আছি!
আমি হাসতে হাসতে বললাম, কেন স্যার, কী হয়েছে?
তিনি ইতস্তত করে বললেন, আপনি তো জানেন সম্প্রতি আমাকে একটা পুরস্কার দেয়া হয়েছে।
- জ্বী স্যার। এটা তো খুবই ভালো একটা বিষয়। তাতে সমস্যাটা কোথায়?
- সমস্যা হলো, পুরস্কার পাওয়ার পর তো আমার শত্রুর সংখ্যা বেড়ে গেছে। অনেকেই তো কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছে।
- এর অর্থ কী?
- আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষক মন খারাপ করেছেন।
- কেন?
- আমার ধারণা, তারা মনে করছেন পুরস্কারটি তারাও পেতে পারতেন।
- তাতে আপনার সাথে কথা বলা বন্ধ করতে হবে কেন?
- আমি তো বুঝতে পারছি না। পুরস্কার তো দেয়া হয় অন্যদেরকে উৎসাহিত করার জন্য। কিন্তু এখন দেখছি হীতে বিপরীত হলো। আমার বিরুদ্ধে অপপ্রচারও চালাচ্ছেন কেউ কেউ। বলেন তো কী করি?
- কারণটা আমার কাছে পরিস্কার না। এটা না বুঝে কীভাবে কী বলি?
- শুনেন, কারণটা খুব পরিস্কার। আমাকে পুরস্কার দেয়াতে অন্যরা অপমানিত হয়েছেন। তারা ভাবছেন, তাদের যোগ্যতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করা হয়েছে।
- কিন্তু পুরস্কার দেয়ার প্রথা তো এসেছে, অন্যরা যেন আপনার মতো ভালো কাজে উদ্ভুদ্ধ হয় সেজন্য? তাই নয় কি?
- ব্যাপারটা তো তাই। কিন্তু এখন তো মনে হচ্ছে, বিষয়টা কাজ করছে না। আমার এই পুরস্কারের দরকার নাই। আমি পুরস্কারটা ফেরত দিয়ে দেই, কি বলেন?
- স্যার, একটু অপেক্ষা করেন। বিষয়টা আরেকটু বুঝে নেই।
- এখানে বুঝাবুঝির তেমন কিছু নাই। এই দেশে আপনি একজনকে পুরস্কৃত করবেন, তাতে অন্যরা অপমানিত হবে। এই যখন মানসিকতা তখন সেই দেশে মানুষ কাজ করবে কীভাবে?
এই ঘটনাটি ঘটার পর দীর্ঘ সময় ধরে আমি ভেবেছি, মানুষের মাথায় কী এমন খেলে যা অন্যকে পুরস্কৃত করলে আরেকজন অপমানিত অনুভব করে। এটা কি এক ধরনের ঈর্ষাপরায়ণতা? আমরা ভালো কাজের দিকে উৎসাহিত না হয়ে, কেন পুরস্কৃত মানুষটিকে টেনে নামানোর চেষ্টা করি? সমস্যাটা কোথায়? দীর্ঘদিন ধরে বিষয়টি আমাকে তাড়া করে বেড়িয়েছে। এটা কি এক ধরনের অসুস্থ প্রতিযোগিতা যা মানুষকে ভিন্নভাবে ভাবতে শেখায়? পুরস্কার প্রাপ্তির আগে সবাই মিলে মিশে কাজ করত। যেই মুহূর্তে একজনকে পুরস্কার দেওয়া হলো, তারপর থেকেই অন্যদের সাথে তার দূরত্ব তৈরি হলো। সেই বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কটা বৈরীতে পরিণত হলো। কিন্তু এটা তো হওয়ার কথা ছিল না। পুরস্কার দেওয়ার উদ্দেশ্য ছিল অন্যদেরকে উৎসাহিত করা। তাহলে কি সেটা কাজ করছে না?
গত সপ্তাহে লিখেছিলাম, ইমোশনাল ব্যাংক একাউন্ট নিয়ে। ড. স্টিফেন কোভে-এর লেখা ‘দি সেভেন হ্যাবিটস অফ হাইলি ইফেক্টিভ পিপল’ বইটির পরের অভ্যাসগুলো হলো পাবলিক ভিক্টোরি নিয়ে।মূলত কীভাবে আপনি আপনার চারপাশের মানুষের সাথে ব্যবহার করবেন এবং নিজের একটি ইমেজ তৈরি করবেন, কীভাবে সামাজিকভাবে আপনি সফল হবেন, সেই অভ্যাসগুলো নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। সেখানে তিনটি অভ্যাসের কথা বলা হয়েছে। আজকে লিখছি তার থেকে প্রথম অভ্যাসটি নিয়ে।
মানুষের সাথে ইন্টার্যাকশনের ছয়টি দৃষ্টান্ত
আপনি একটি প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহী হোন, কিংবা সাধারণ কর্মী, কিংবা একজন সাদামাটা মা-বাবা, আপনি যখনই অন্য কারও সাথে ইন্টার্যাক্ট করতে যাবেন, সেই মুহূর্তে আসলে আপনি অন্যের উপর নিজের ছাপ রেখে যাচ্ছেন। সেটা মা-বাবা হিসেবে যেমনটা করছেন আপনার সন্তানের উপর, একজন বিক্রেতা হিসেবে করছেন ক্রেতার উপর, একজন কর্মী হিসেবে করছেন অন্যান্য কর্মীর উপর। আপনি যদি সেই ইন্টার্যাকশনকে পাত্তা না দেন, তাহলে ভিন্ন কথা। কিন্তু যদি দীর্ঘ মেয়াদী প্রভাব ফেলতে চান, তাহলে আপনাকে বুঝতে হবে এই আদান-প্রদানের ফরম্যাটটা কেমন হয়।
মানুষ মূলত ছয়টি উপায়ে অন্য মানুষের সাথে আদান-প্রদান করে থাকে। সেগুলো হলো-
১. উইন/উইন, ২. উইন/লুস, ৩. লুস/উইন,
৪. লুস/লুস, ৫. উইন, ৬. উইন/উইন, নয়তো নো-ডিল।
আমি ইচ্ছে করেই এই টার্মগুলোকে বাংলা করলাম না। এগুলো বহুল প্রচলিত শব্দ। বাংলা করতে গেলে মূল ভাবটি নষ্ট হতে পারে। উইন/লুস এগুলো আমরা সবাই কম/বেশি বুঝি। তাই এটা নিয়েই আগানো যাক। এবং এই ছয়টি বিষয় নিয়ে কিছুটা আলোচনা করি, যেন আপনি বুঝতে পারেন আপনার ব্রেইনটি কীভাবে প্রোগ্রাম করা। তার উপর নির্ভর করবে, আপনি আসলে কতটা ইফেক্টিভ হতে পারবেন।

১. উইন/উইন
উইন/উইন হলো মানুষের মনের একটি ফ্রেমওয়ার্ক, যা প্রতিনিয়ত উভয় পক্ষের ভালোটা খুঁজতে থাকে। এটা আসলে কোনোও টেকনিক কিংবা উপায় নয় যে আপনি ক্ষেত্র বিশেষ প্রয়োগ করে লাভবান হয়ে যাবেন। এটা হলো একধরনের দর্শন যা আপনার ভেতর থাকবে, নয়তো থাকবে না। যদি থাকে, তাহলে সব সময়ই থাকবে। আর যদি না থাকে, তাহলে আপনি এটাকে একটা টেকনিক হিসেবে প্রয়োগ করতে পারবেন না। আপনাকে মূলত এই গুণটি অর্জন করতে হবে।
এই গুণের মানুষগুলো সবকিছুতেই উভয়পক্ষের স্বার্থটি খেয়াল রাখে। তারা বিশ্বাস করে, যেকোনোও ইন্টার্যাকশনেই উভয়কেই জিততে হবে, উভয়কেই ভালো অনুভব করতে হবে এবং উভয়কেই পরিতৃপ্ত হতে হবে। উইন/উইন চিন্তার মানুষগুলো একটু ভিন্ন ধরনের হয়। তারা উভয়ই সিদ্ধান্তগুলোর বিষয়ে ভালো অনুভব করে, এবং সেটাকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার জন্য অনেক বেশি দৃঢ় সংকল্প থাকে। এরা পৃথিবীকে প্রতিযোগিতাপূর্ণ কোনোও খেলার মাঠ হিসেবে দেখে না; এরা মূলত সহযোগিতা এবং সহমর্মিতা দিয়ে পরিচালিত হয়। এরা সব কিছুতেই সহযোগিতার হাত দেখতে পায়। অনেকেই সব কিছুতেই হার/জিত দেখতে পায় এবং সেভাবেই পৃথিবীতে দেখতে অভ্যস্ত। কিন্তু উইন/উইন মানসিকতার মানুষগুলো সেভাবে পৃথিবীতে দেখে না। তারা মনে করে না যে, এই পৃথিবীতে রিসোর্সের সংকট রয়েছে। তারা মনে করে না যে, অন্যেরটা কেড়ে নিয়ে নিজেরটা বড় করতে হবে। তারা বিশ্বাস করে, এই পৃথিবীতে অনেক আছে, সেটা সবাই ভাগ করে নিলেও নিজের কমতি হবে না। তারা একটা নীতির উপর নির্ভর করে পরিচালিত হয়। তারা মনে করে না যে, একজনের সাফল্য আরকজনের ব্যর্থতার উপর দাঁড়িয়ে করতে হবে।

২. উইন/লুস
বাংলাদেশের আমি যত মানুষের সাথে উঠাবসা করেছি, সেখান সবচে’ বেশি সংখ্যক মানুষ হলো ‘উইন/লুস’ স্ক্রিপ্ট পরিচালিত মানুষ। তাদের ব্রেইনে এই স্ক্রিপ্টটা ট্যাটু করে ছাপ দেওয়া রয়েছে। তারা সব সময় জিততে চায় এবং অন্যকে ঠকিয়ে জিততে চায়। এর বাইরে এরা ভাবতেই পারে না। সবসময় মাথায় থাকে, ‘আমি জিতব, তুমি হারবে’। একটা কঠিন প্রতিযোগিতার ভেতর নিজেকে গড়ে তুলেছে এই গোত্রের মানুষগুলো।
আপনি যখনই কোনোও লিডারশীপ পজিশনে যাবেন, এবং ভেতর আপনার স্ক্রিপ্টটা হলো ‘উইন/লুস’ দিয়ে লেখা, আপনি সবসময় আপনার ক্ষমতা, অবস্থান, লিংক সবকিছু ব্যবহার করবেন যেন আপনি সবসময় জিততে পারেন। এবং আপনি সবসময় নিশ্চিত করার চেষ্টা করবেন, অন্যেরা যেন পরাজিত হয়।
গবেষণায় দেখা গেছে, এই ধরনের স্ক্রিপ্ট বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তাদের খুব ছোটবেলা থেকেই মাথায় গেথে যায়। তারা বেড়ে ওঠে এই ফর্মূলা দিয়ে। তারা তাদের পরিবার থেকে এটা পেয়ে থাকে। ছোটবেলায় তার মা-বাবা যখন তার সাথে অন্য ভাইবোনদের তুলনা করা শিখিয়েছে, তখন থেকেই তার ভেতর এটা ঢুকে গেছে। পরিবারের যে ছেলেটি কিংবা মেয়েটি লেখাপড়ায় ভালো, তাকে যখন বেশি আদর করা হচ্ছে, সবার ব্রেইনে এটা ঢুকে যাচ্ছে যে, মা-বাবার ভালোবাসা অর্জন করতে হলে তাকে লেখাপড়ায় জিততে হবে। তাকে কোনোও না কোনোও কিছুতে জিততে হবে, তখনই তার ভেতর অন্যকে হারিয়ে নিজে জেতার একক মানসিকতা তৈরি হয়ে যায়। আমরা মা-বাবারা প্রতিনিয়ত একেকটি বাচ্চার সাথে অন্য বাচ্চার তুলনা করি, কখনও নিজের পরিবারের ভেতর, কখনও খালাতো-চাচাতো ভাই-বোনদের ভেতর। এই তুলনামূলক আচরণ শিশুটির ভেতর যে এক ধরনের প্রতিযোগিতামূলক মানসিকতা তৈরি করছে, সেটা আমরা খেয়াল করি না। আমরা তাদের ভেতর সহযোগিতার মনোভাব জাগিয়ে তুলি না। আমরা তাদেরকে একটি কঠিন প্রতিযোগিতার ভেতর ফেলে দেই।
এবং এই বয়সে প্রতিটি শিশু খুব ভালনারেবল থাকে। সে বুঝতে শেখে, ‘আমি যদি আমার ভাইয়ের চেয়ে ভালো করি, তাহলে আমার মা-বাবা আমাকে বেশি আদর করবে’। সে ভাবতে শেখে, ‘আমাকে আমার মা-বাবা আমার বোনের মতো ভালোবাসে না। আমার মূল্য কম’।
এই ধরনের স্ক্রিপ্ট তৈরিতে আরেকটি স্থান হলো আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা। আমাদের স্কুল, কলেজ কিংবা বিশ্ববিদ্যালয় কোথাও সহযোগিতার মনোভাব নেই। আমরা ক্লাসে একটি চরম প্রতিযোগিতাপূর্ণ পরিবেশ তৈরি করি। প্রতিদিন ক্লাসে শিখাই, ও ফার্স্ট হয়েছে (তাকে বেশি আদর করো), এই মেয়েটি সবচে’ ভালো (তার মা-বাবাকে জানিয়ে খুশি করো), ওই ছেলটি ফুল মার্কস পায়নি (তাকে আদর করা যাবে না) ইত্যাদি স্ক্রিপ্ট আমাদের কাছে লেখা আছে। ছাত্রছাত্রীরাও এটা জানে। তাই আমাদের দেশে ফার্স্ট বয় আর সেকেন্ড বয় (কিংবা গার্ল)-এর ভেতর বন্ধুত্ব তৈরি হয় না। একটু বন্ধুত্ব হলেও সহযোগিতার হাত খোলা থাকে না। তাদের ভেতর এক ধরনের চরম বৈরী প্রতিযোগিতামূলক সম্পর্ক থাকে। তারা টিম প্লেয়ার হয় না।
আমাদের জীবনে প্রতিযোগিতার জায়গা রয়েছে। খেলায় হার/জিত থাকবে। কিন্তু একটি দলের খেলোয়ারদের নিজেদের ভেতর প্রতিযোগিতা থাকলে সেখানে ভালো কিছু হওয়ার সুযোগ নেই। সেখানে বিশ্বাস থাকে না, পারস্পারিক আস্থা থাকে না। ফুটবলে খেলায় সবাই যখন গোল দেওয়া নিয়ে ব্যস্ত থাকে, তখন আসলে পুরো দলকেই গোল খেতে হয়।
আমাদের দৈনন্দিন জীবনে প্রতিদিন নিজের ভাইবোনের মধ্য প্রতিযোগিতা, সহকর্মীদের সাথে প্রতিযোগিতা, আমাদের সন্তানদের ভেতর প্রতিযোগিতা, প্রতিবেশীর সাথে প্রতিযোগিতা, বন্ধুদের সাথে প্রতিযোগিতা করে বেঁচে থাকাটা অর্থহীন। একটি বিয়েতে যদি প্রশ্ন করা হয়, ‘এই বিয়েতে কে জিতল?’ কেমন শোনায় প্রশ্নটি? এখানে উভয়ই যদি না জিতে, তাহলে কেউই আসলে জিতল না; উভয়ই হারল।

৩. লুস/উইন
আমাদের আশেপাশে এমন মানুষের সংখ্যাও কম নয়, যারা সারাক্ষণ নিজেকে ‘হেরে’ যাওয়ার জন্য প্রস্তুত করে রাখে। তাদের ব্রেইনে স্ক্রিপ্টটা এভাবে লেখা-
- আমি হারলাম, তুমি জিতো।
- আমার বলার কিছু ছিল না, না গো...
- যাও, তোমার যেভাবে সুবিধা হয় করো...
- আমাকে মারিয়ে যাও, সবাই তো তাই করছে।
- আমি একজন হেরে যাওয়া মানুষ; আমি লুসার।
- আমি শান্তিপ্রিয় মানুষ। আমি শান্তির জন্য সব করতে পারি।
যাদের ব্রেইনে সবসময় ‘লুস/উইন’ করার মানসিকতা চলতে থাকে, তারা আসলে ‘উইন/লুস’ করার মানসিকতার থেকেও খারাপ। অনেকেই ভাবতে পারেন, না আমি অন্যকে জিততে সাহায্য করি, তাতে খারাপের কি আছে? আমি মানুষের উপকার করি, এবং নিজে হেরে গিয়ে অন্যকে জেতানোর মতো আনন্দে আপ্লুত হই। কিন্তু বিষয়টি অন্য জায়গায়। এই ধরনের মানুষদের কোনোও মানদণ্ড থাকে না। তাদের কোনোও স্ট্যান্ডার্ড নেই। তাদের চাহিদা নেই, প্রত্যাশা নেই, ভিশন নেই। তারা অন্যকে খুশি করার জন্য যে কোনোও পর্যায়ে নামতে পারে। তারা সস্তা জনপ্রিয়তা কিংবা অন্য মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্যতা দিয়ে পরিচালিত হয়। তাদের নিজের কোনোও ব্যক্তিত্ব থাকে না। নিজেকে প্রকাশ করার মতো সাহস এদের থাকে না।
সমস্যা আরও আছে। যদিও এরা নিজে হেরে গিয়ে অন্যকে জিততে সাহায্য করে বলে দাবি করে থাকে, কিন্তু অবচেতন মনে তাদের সেই চাহিদা থেকেই যায়। অবচেতন মনের সেই চাওয়ার কখনই মৃত্যু হয় না। তারা বেঁচে থাকে; আর যখন সেগুলো ফিরে আসে তখন তা খুবই নোংরা একটা রূপ নেয়। এটা তখন একটি রোগে পরিণত হয়। আপনারা কেউ কি কখনও এমন কোনোও নারীকে দেখেছেন যিনি দিনের পর দিন, বছরের পর বছর সব কিছু মেনে নিয়ে অবহেলায় জীবন-যাপন করেছেন? তারপর সামান্য কোনোও প্ররোচনায় সেই রাগের আগুন কীভাবে বাইরে বেরিয়ে এসেছে? সেই আগুনের তাপ কি দেখেছেন কেউ?
উইন/লুস এবং লুস/উইন উভয়ের ভেতরই এক ধরনের নিরাপত্তাহীনতা থাকে। সাময়িকভাবে উইন/লুস মানুষের ফলাফল ভালো দেখা যায়, কারণ তারা দ্রুত ফলাফলে বিশ্বাস করে। চট করেই কিছু জিতে ফেলা, কিংবা অন্যকে ঠকিয়ে কোনোও কাজ হাসিল করে ফেলতে এদের জুড়ি নেই। তাই সাময়িকভাবে এদের অনেক উন্নতি পরিলক্ষিত হয়। অপরপক্ষে লুস/উইন দলের মানুষরা দুর্বল এবং বিশৃঙ্খল হয়। অনেক এক্সিকিউটিভ, ম্যানেজার এমন-কি মা-বাবারা প্রতিনিয়ত উইন/লুস আর লুস/উইন-এর দোলাচলে দুলতে থাকেন, অনেকটা ঘড়ির পেন্ডুলামের মতো। তারা একবার উইন/লুস দিকে যান, আরেকবার ধাক্কা খেয়ে লুস/উইন দিকে চলে আসেন। পরে আবার অভিমানে, রাগে ক্ষত-বিক্ষত হয়ে আবার উইন/লুস-এর দিতে যেতে থাকেন। এভাবেই কেটে যায় তাদের সারাটা জীবন।
৪. লুস/লুস
অনেকেই হয়তো ভাবছেন, এমন মানুষও কি এই পৃথিবীতে আছে যারা উভয়ের ক্ষতি চায়? কেউ কি এমনভাবে ভাবতে পারে যে, দুজনেরই এক সাথে ক্ষতি হবে, আমিও ডুবব, তোকে নিয়ে ডুবব?
জ্বী, এমন মানুষের সংখ্যাও কম নয়।
আমার নিজের দেখা একজন মানুষের কথা বলি। সম্প্রতি তাদের বিবাহবিচ্ছেদ হয়েছে। আমেরিকার কোর্ট ছেলেটিকে নির্দেশ দিয়েছে যে, তাদের সম্পত্তির অর্ধেক মেয়েটিকে দিতে হবে, আগামী পাঁচ বছর মেয়েটির ভরণ-পোষণের জন্য ছেলেটির মাসিক বেতনের অর্ধেক টাকা মেয়েটিকে দিতে হবে।
ছেলেটি বুয়েটের ইঞ্জিনিয়ার, আমেরিকার খুব ভালো একটি সফটওয়্যার প্রতিষ্ঠানে কাজ করত। তার বেতনও ছিল বেশ ভালো। কিন্তু সে একদিন সেই চাকরি ছেড়ে দিল। সে নিকটবর্তী শহরে গিয়ে একটি ভবনের দারোয়ানের চাকরি নিল, যেখানে তার থাকা-খাওয়া ফ্রি, আর বেতন খুবই সামান্য। মেয়েটিকে যেন কোনোও টাকা দিতে না হয়, সেজন্য সে ব্যাংকের মাধ্যমে বেতন নেওয়া বন্ধ করে দিল। বাড়ির মালিকের কাছ থেকে ক্যাশে বেতন নিত। তার স্ত্রী-কে অর্ধেক দিতে হবে বলে নিজেকে এমন জায়গায় নিয়ে গেছে যে, যেই জীবন সে কখনই হয়তো কল্পনা করেনি। একেই হয়তো বলে, নিজের নাক কেটে পরের যাত্রা ভঙ্গ করা।
এমন মানুষের সংখ্যা কি কম পাওয়া যাবে?

৫. শুধুই উইন
আমাদের চারপাশে আরেক দল মানুষ আছে যারা শুধু নিজেরটা দেখতে পায়, এবং সেটা অবশ্যই ‘উইন’; আর অপর পক্ষ জিতল নাকি হারল তা নিয়ে মাথা ব্যাথা নেই। সে নিজে জিতেছে কিনা, সেটাই মুখ্য বিষয়। অন্যরা কি পেল আর পেল না, তা নিয়ে তাদের চিন্তা নেই। সে নিজে যা চেয়েছে তা পেয়েছে কি না, সেটাই মূখ্য।
এই ধরনের মানুষরা নিজেরটা বুঝে নিয়ে চুপ করে থাকে। তারা অন্যেরটা অন্যপক্ষ বুঝুক, সেটাই ছেড়ে দিয়ে বসে থাকে। এরা ভাবে, যারটা সে বুঝে নিক, আমি কেন মাথা ঘামাব!

৬. উইন/উইন, নয়তো নো-ডিল
অনেক সময় উইন/উইন মানসিকতা নিয়ে কোথাও গেলে, উল্টো পাশেও যে একই মানসিকতার লোকজন থাকবে তা কিন্তু নয়। আপনি চাইলে উভয়ের ভালো হোক, কিন্তু আপনার উল্টো দিকে বসে আছে একজন কট্টর উইন/লুস মানুষ; অর্থাৎ সে আপনাকে ঠকাবেই। সেক্ষেত্রে আপনাকে কম্প্রোমাইজ করা লাগতে পারে। অনেক সময় আমরা কম্প্রোমাইজ করে জীবন চালিয়ে নিই।
কিন্তু কিছু মানুষ আছে যারা সেটা করবে না। তারা চাইবে একটি উইন/উইন অবস্থানে পৌঁছানোর জন্য। যদি সেটা করা না যায়, সেক্ষেত্রে পুরো ডিলটাই বন্ধ করে দেবে; তারা কোনোও ডিলে যাবে না। এই দলের মানুষরা খুব পরিস্কার করে বলে দেবে, আমি কেবলমাত্র উইন/উইন অবস্থান ছাড়া সামনে এগুবো না। আমি নিজে জিততে চাই এবং আমি চাই আপনিও জিতুন। আমি চাই, দু’জনই এই থেকে জিতুন। নইলে কিছুদিন পর এই ডিলটা কাজ করবে না। আপনি নয়তো আমি উৎসাহ হারিয়ে ফেলব। সেক্ষেত্রে এটা কারো জন্যই মঙ্গল হবে না।
এমন-কি পারিবারিক ক্ষেত্রেও এটা প্রযোজ্য। ধরুন, এক সন্ধ্যায় আপনি আপনার মামাতো-চাচাতো ভাই-বোনদের নিয়ে ভিডিও দেখার পরিকল্পনা করলেন। কিন্তু একেকজন একেক কাজ করবে বলে ঠিক করল। কেউ ভিডিওতে এই ছবি দেখতে চায়, অন্যরা অন্য কিছু। আপনি চাইলে কিছু সংখ্যক মানুষকে নিয়ে পছন্দের একটি মুভি দেখতে পারেন। কিন্তু আপনি যদি পুরো ভিডিও দেখার পরিকল্পনাটাই বাদ দিয়ে দেন, তাহলে সেটা হয়তো আরও ভালো হবে। সবাইকে যদি একটি উইন/উইন অবস্থানে আনা না যায়, সেক্ষেত্রে সেটা বাদ দিয়ে দেওয়াটাও মন্দ নয়।
কোন অপশনটা ভালো?
আমি আগেই বলেছি, বাংলাদেশে আপনি যাদের সাথে কাজ করতে যাবেন সেখানে উইন/লুস মানসিকতার মানুষ অনেক বেশি পাবেন। তারা যেকোনোও অবস্থাতেই জিততে চাইবে। আপনার দিকটা দেখবে না। আর আপনি নিজেও যদি উইন/লুস ধরনের হন, তাহলে তো বুঝতেই পারছেন অবস্থা।
বাংলাদেশে দীর্ঘদিন সুনামের সাথে ব্যবসা করছে এমন প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা খুব কম। তার মূল কারণই হলো, তারা উইন/লুস হিসাবে বিশ্বাস করে। তারা তাদের ক্রেতাদেরকে ঠকাতে পর্যন্ত কুণ্ঠিত নয়। বাংলাদেশের গ্রাহকরা ঠকবেন, সেটা মাথায় নিয়েই দোকানে যান। তারা কদাচিৎ কোনোও প্রতিষ্ঠানকে বিশ্বাস করেন। তাই এখানে বিগত ৪০ বছরে কয়টি প্রতিষ্ঠান আপনি দেখাতে পারবেন, যারা নিষ্ঠা এবং সততার সাথে প্রকৃত উইন/উইন মেনে টিকে আছেন। এরা খুব স্বল্প সময়ে অনেক টাকার মালিক হয়ে তারপর মাঠ থেকে সরে যান। এটাই বাংলাদেশের ব্যবসার ধর্ম। একই প্রভাব পড়ে সামাজিক জীবনে, বন্ধুত্বে, পারিবারিক বন্ধনে।
উপরের আলোচনা থেকে যদি এবারে জিজ্ঞেস করি, কোন পন্থাটি সেরা তাহলে আপনার উত্তর কী হবে? নিশ্চই মনে মনে ভাবছেন, উত্তর সোজা- উইন/উইন।
আসলে তা নয়। এটা নির্ভর করে পরিস্থিতির উপর। যেমন আপনি একটি ব্যবসা করছেন এবং বাজারে প্রতিযোগিতা করতে হচ্ছে। সেক্ষেত্রে আপনাকে হয়তো উইন/লুস পদ্ধতি অনুসরণ করতে হতে পারে। কিন্তু নিজের প্রতিষ্ঠানের ভেতর কর্মীদের ভেতর যদি উইন/লুস প্রয়োগ করেন, কিংবা আপনার গ্রাহকের সাথে- তাহলে আপনি দীর্ঘ মেয়াদে হেরে যাবেন।
কিছু কিছু ক্ষেত্রে আপনাকে লুস/উইন অবস্থানে যাওয়া লাগতে পারে। যেমন ধরুন একটি সম্পর্কে জড়ালেন। অপর দিকের মানুষটিকে কমফোর্ট দেওয়ার জন্য আপনাকে মাঝে মাঝে হারতে হতে পারে। তাতে তেমন কিছু আসে যায় না, যখন আপনি জানেন কেন কাজটি করছেন।
তবে উপরের সবগুলো বিবেচনা করলে, সাধারণ ক্ষেত্রে আপনি সবসময় উইন/উইন অবস্থানে থাকার চেষ্টা করুন। কিছু কর্নার কেস থাকবে। সেগুলোকে বিবেচনায় না এনে, দীর্ঘ মেয়াদী যদি লাভবান হতে চান, তাহলে উইন/উইন হবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে আপনার অবস্থান। তাতে আপনার সাথে কাজ করতে সবাই সাচ্ছন্দ্য বোধ করবে, আপনার সাথে ব্যবসা করতে অন্য প্রতিষ্ঠানগুলো পছন্দ করবে, আপনার উপর মানুষ আস্থা রাখবে। কেউ এটা মনে করবে না যে, আপনার সাথে কাজ করতে গিয়ে তাকে ঠকতে হতে পারে।
আমি আমার জীবন দিয়ে বাংলাদেশে দেখেছি, কদাচিৎ কেউ উইন/উইন চিন্তা করে। আমার সাথে যারাই উইন/লুস মোডে কাজ করতে এসেছেন, তাদেরকে আমি একটি বার মাত্র সুযোগ দিয়েছি। তারপর তাদের সাথে সম্পর্ক নষ্ট হয়েছে। এবং এটা যে হবেই, সেটা লিখিত। তাই এখন থেকে আমি ‘উইন/উইন, নয়তো নো-ডিল’ মোডে চলে গেছি। অনেকেই আমাকে অনেক কিছু করতে বলেন। অনেকেই অনেক কিছু অফার করেন। যতক্ষণ না সেটা উভয়ের জন্য উইন/উইন ততক্ষণ আমি সেটাতে জড়াই না। এজন্য অনেক সময় অনেক কাজ হয় না। তাতে সমস্যা নেই। আপাত দৃষ্টিতে সেটা হলো না, কিন্তু যদি সেটা হতো, সেই মানুষটির সাথে পরবর্তীতে গিয়ে ঝামেলা হতোই। কারণ সে হয়তো আমাকে ঠকিয়েছে, নয়তো আমি তাকে ঠকিয়েছি। এর কোনোটাই কারও জন্য ভালো বয়ে আনতে পারে না।
লেখার শুরুতেই যে গল্পটি বলেছিলাম, তা আমাদের জীবনে বর্তমান। আমরা সবকিছুতেই একটা প্রতিযোগিতামূলক উইন/লুস হিসাবে ফেলে দিয়েছি। আমরা সহযোগিতার হাত বাড়াতে শিখিনি; আমরা উভয়ের মঙ্গল হবে এটা ভাবতে শিখিনি। তাই জাতি হিসেবেও আমাদেরকে অনেকটা পিছিয়ে থাকতে হয়েছে। এখন থেকে যখনই কোনোও কাজে হাত দেবেন, মাথায় রাখবেন বিষয়টি সবার জন্য উইন/উইন হচ্ছে কি না।দেখবেন, দীর্ঘমেয়াদে আপনি একজন ইফেক্টিভ মানুষে পরিনত হয়েছেন।

No comments

Featured post

একনায়িকাতন্ত্র

আমার বুকের ভেতরের "মন" নামক রাষ্ট্রে ভালোবাসার অজুহাতে যে স্বৈরাচারী শাসন ব্যবস্থা চলছে, তার নাম একনায়িকাতন্ত্র। নায়িকার ইচ্ছেমতো...

Powered by Blogger.