যে জটিল প্রক্রিয়ায় নির্বাচিত হন একজন মার্কিন প্রেসিডেন্ট


===========================
২০১৭ সালের জানুয়ারি থেকে চার বছরের জন্য নতুন নেতা পাবে বিশ্বের ক্ষমতাধর দেশ যুক্তরাষ্ট্র। আর সেই লক্ষ্যে ৮ নভেম্বর অনুষ্ঠিত হবে আনুষ্ঠানিক ভোটগ্রহণ। দেশের রাষ্ট্রপ্রধান, সরকার প্রধান, সামরিক বাহিনীর কমান্ডার ইন চিফ তথা প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত করবেন মার্কিনিরা। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে প্রভাব বিস্তারকারী দেশটির গুরুত্বপূর্ণ এ নির্বাচনের দিকে তাই দৃষ্টি রয়েছে বিশ্বেরও। তবে কিভাবে প্রেসিডেন্টকে বেছে নেবেন মার্কিন জনগণ? নির্বাচন পদ্ধতিটি কী? নিচে তা নিয়ে আলোচনা করা হলো।
যুক্তরাষ্ট্রে যারা প্রেসিডেন্ট হওয়ার যোগ্যতা রাখেন
প্রেসিডেন্ট পদে লড়ার জন্য প্রার্থীকে জন্মসূত্রে যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক হতে হয়। প্রার্থীর বয়স অন্তত ৩৫ বছর হতে হবে এবং ১৪ বছর ধরে তাকে যুক্তরাষ্ট্রের বাসিন্দা হতে হবে। ১৯৩৩ সাল থেকে এ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র যতজন প্রেসিডেন্ট পেয়েছে তাদের প্রায় প্রত্যেকেই প্রেসিডেন্ট হওয়ার আগে গভর্নর, সিনেটর কিংবা পাঁচ তারকার সামরিক জেনারেল ছিলেন।
যে দিনটিতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়
নভেম্বর মাসের প্রথম সোমবারের পরের মঙ্গলবার দিনটিতে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। অর্থাৎ নভেম্বর মাসের ১ তারিখ যদি মঙ্গলবার হয় তবে সে দিনটিতে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে না। পরবর্তী সপ্তাহের মঙ্গলবারে হবে। আর সে অনুযায়ী এবারের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের জন্য ৮ নভেম্বর তারিখটি নির্ধারণ করা হয়েছে।
কোথায় কোথায় ভোট
যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানী ওয়াশিংটন ডিসি, ৫০টি অঙ্গরাজ্য ৮ নভেম্বর সকাল থেকে ভোটগ্রহণ শুরু হবে। এবারের নির্বাচনে নিবন্ধনকৃত ভোটারের সংখ্যা 20.10 কোটি। এরইমধ্যে ৩৮টি অঙ্গরাজ্যে আগাম ভোট চলছে। আগাম ভোটার বিশেষ করে প্রবাসী ভোটাররা ডাকযোগে এবং অনলাইনে ভোটাধিকার প্রয়োগ করছেন। তবে সরাসরি ভোটকেন্দ্রে ভোটগ্রহণ হবে ৮ নভেম্বর। এরইমধ্যে ২ কোটি ৪০ লাখেরও বেশি মানুষ তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করেছেন। আগাম ভোটদাতা ও ৮ নভেম্বরের ভোটদাতাদের নির্বাচিত ইলেক্টররাই মূলত প্রেসিডেন্ট ও ভাইস প্রেসিডেন্ট বেছে নেন।
ইলেক্টোরাল কলেজ কী?
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ও ভাইস প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের জন্য ইলেক্টরাল কলেজ আনুষ্ঠানিক কর্তৃপক্ষ হিসেবে ভূমিকা পালন করে। ৫৩৮ জন ইলেক্টরের সমন্বয়ে ইলেক্টরাল কলেজ গঠিত। প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হতে হলে প্রার্থীকে এর মধ্যে অন্তত ২৭০টি ইলেক্টোরাল ভোট পেতে হয়। প্রতিটি অঙ্গরাজ্যের কংগ্রেসনাল প্রতিনিধিদের সংখ্যার ভিত্তিতে ইলেক্টর নিযুক্ত করা হয়। ডিস্ট্রিক্ট অব কলম্বিয়ায় কোনও কংগ্রেস প্রতিনিধি না থাকায় সেখানে তিনজন ইলেক্টর এমনি নিযুক্ত করা হয়। অর্থাৎ সর্বমোট ৪৩৫ জন হাউজ রিপ্রেজেন্টিটিভ, ১০০ জন সিনেটর ও ডিস্ট্রিক্ট অব কলম্বিয়ার তিন ইলেক্টরসহ ৫৩৮ জন ইলেক্টর হিসেব করা হয়।
ইলেক্টর ভাগ হয় যেভাবে
এক এক স্টেটে ইলেক্টরের সংখ্যা এক এক রকম। নির্বাচনের দিন মার্কিনিরা যখন ভোট দেন তখন তারা মূলত প্রার্থীদের বাছাইকৃত ইলেক্টরদেরকে ভোট দেন। দুটি ছাড়া বাকি ৪৮টি অঙ্গরাজ্যে ‘উইনার-টেক-অল’ সিস্টেম চালু রয়েছে। এর আওতায় জয়ী প্রার্থীকে সব ইলেক্টর দিয়ে দেওয়া হয়। এরমধ্যে সবচেয়ে বেশি ইলেক্টর রয়েছে ক্যালিফোর্নিয়ায়। এখানকার ইলেক্টরের সংখ্যা ৫৫। এরা সাধারণত দলের কর্মী, সদস্য বা দলের প্রতি অনুগত লোকজন। প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের অংশ হিসেবে ক্যালিফোর্নিয়ার মানুষ যখন ভোট দেন তখন তারা মূলত তাদের পছন্দের প্রেসিডেন্ট প্রার্থীকে নয় বরং তার নিযুক্ত ইলেক্টরদের ভোট দেন। এখন ক্যালিফোর্নিয়াতে যে জিতবে সে প্রার্থী ৫৫ জন ইলেক্টরই জয় করে নেবেন। আর তার প্রতিদ্বন্দ্বী কোনও ইলেক্টর পাবেন না। এভাবে গোটা যুক্তরাষ্ট্রে থাকা ৫৩৮ পয়েন্টের ভেতর কেউ যদি অর্ধেকের চেয়ে এক বেশি অর্থাৎ অন্তত ২৭০ পয়েন্ট পায়, তাহলে সে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হয়ে যাবে।
৫০টি অঙ্গরাজ্য, ওয়াশিংটন ডিসি ও ডিস্ট্রিক্ট অব কলম্বিয়ার ইলেক্টরাল ভোটের সংখ্যা
ওয়াশিংটন ডিসিতে ১২টি, মন্টানায় ৩টি, নর্থ ডাকোটায় ৩টি, মিনেসোটায় ১০টি, উইসকনসিনে ১০টি, মিশিগানে ১৬টি, নিউ ইয়র্ক ২৯টি, ভারমন্টে ৩টি, নিউ হ্যাম্পশায়ারে ৪টি, মেইনে ৪টি, ম্যাসাচুসেটসে ১১টি, রোড আইল্যান্ডে ৪টি, কানেকটিকাটে ৭টি, নিউ জার্সিতে ১৪টি, ডেলাওয়ারে ৩টি, ম্যারিল্যান্ডে ১০টি, ডিস্ট্রিক্ট অব কলাম্বিয়াতে ৩টি ইলেক্টরাল ভোট রয়েছে।
এছাড়া ওরিগনে ৭, ইডাহোতে ৪টি, ওয়াইওমিং এ ৩টি, সাউথ ডাকোটায় ৩টি, নেবরাস্কায় ৫টি, আইওয়াতে ৬টি, ইলিনয়ে ২০টি, ইন্ডিয়ানায় ১১টি, ওহাইওতে ১৮টি, পেনসিলভানিয়ায় ২০টি, নেভাদায় ৬টি, ইউটায় ৬টি, কলোরাডোতে ৯টি, কানসাসে ৬টি, মিসৌরিতে ১০টি, কেন্টাকিতে ৮টি, ওয়েস্ট ভার্জিনিয়ায় ৫টি, ভার্জিনিয়াতে ১৩টি, ক্যালিফোর্নিয়ায় ৫৫টি, ‌আরিজোনায় ১১টি, নিউ মেক্সিকোতে ৫টি, টেক্সাসে ৩৮টি, ওকলাহোমায় ৭টি, আরকানসাসে ৬টি, টেনেসিতে ১১টি, নর্থ ক্যারোলিনায় ১৫টি, লুইজিয়ানায় ৮টি, মিসিসিপিতে ৬টি, আলাবামায় ৯টি, জর্জিয়ায় ১৬টি, সাউথ ক্যারোলিনায় ৯টি, ফ্লোরিডায় ২৯টি, হাওয়াইতে ৪টি এবং আলাস্কায় ৩টি ইলেক্টরাল ভোট রয়েছে।
এক এক অঙ্গরাজ্যের ইলেক্টরের সংখ্যা একেকরকম কেন?
সাধারণত জনসংখ্যার ওপর ইলেক্টরের সংখ্যা নির্ভর করে। নিয়ম হল, প্রতিটি অঙ্গরাজ্যে জনসংখ্যা যেমনই হোক, নুন্যতম তিন পয়েন্ট দিতেই হবে। এরপর জনসংখ্যা অনুসারে এই সংখ্যা নির্ধারণ করা হয় প্রতি ১০ বছর পরপর। যেমন ২০০৪ সালে ফ্লোরিডার ছিলো ২৭ ইলেকট্রোরাল কলেজ। এখন ২৯ হয়েছে। অর্থাৎ ফ্লোরিডাতে জনসংখ্যা বেড়ে গেছে। ছোট অঙ্গরাজ্যগুলো যাতে নির্বাচনে গুরুত্ব না হারায় সে বিষয়টিকে এক্ষেত্রে মাথায় রাখা হয়। যেমন মন্টানা অঙ্গরাজ্যের জনসংখ্যা ১০ লাখ। আবার ওয়াইওমিং অঙ্গরাজ্যের জনসংখ্যা ৫ লাখ ৮৪ হাজার। অথচ দুইটা রাজ্যেরই ইলেক্টোরাল ভোট সমান। তিনটা করে।
অর্থাৎ ১০ লাখ জনসংখ্যার মন্টানাতে জিতে যে সংখ্যক ইলেক্টোরাল ভোট পাওয়া যাবে তার চেয়ে অর্ধেক জনসংখ্যার রাজ্য ওয়াইমিং-এ জিতেও ৩ পয়েন্ট পাওয়া যাবে।
আনুষ্ঠানিক ফলাফল
১৯ ডিসেম্বর ইলেক্টররা আনুষ্ঠানিকভাবে প্রেসিডেন্ট ও ভাইস প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত করার জন্য মিলিত হবেন। ইলেক্টর যদি প্রতিশ্রুতি মোতাবেক কোনও প্রার্থীকে ভোট না দিয়ে অন্য প্রার্থীর জন্য ভোট দেন তবে তাকে ‘বিশ্বাসহীন ইলেক্টর’ বলে মনে করা হয়। তবে ইলেক্টররা সাধারণত এমনটা করেন না। ২০১৭ সালের ৬ জানুয়ারি ভোটগুলো গণনা করা হবে এবং সিনেট প্রেসিডেন্ট ও বর্তমান ভাইস প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ফলাফল ঘোষণা করবেন।
পপুলার ভোট তথা আমজনতার ভোটে হেরে যাওয়ার পরও ইলেক্টরাল ভোটে জিতে প্রেসিডেন্ট হওয়ার সংখ্যাটা হাতে গোনা। যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে এ ধরনের নির্বাচনের সংখ্যা চারটি। সর্বশেষ ২০০০ সালে আল গোরের কাছে পপুলার ভোটে হেরে যাওয়ার পরও ইলেক্টরাল কলেজ ও সুপ্রিম কোর্টের কল্যাণে নির্বাচনে জিতে যান জর্জ ডব্লিউ বুশ।
যেসব নির্বাচনে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হয় এবং যখন কোনও প্রার্থী পপুলার ভোটে না জিতেও প্রেসিডেন্ট হিসেবে জয় পান, তখনই ইলেক্টরাল কলেজ সিস্টেমে পরিবর্তন আনার জন্য আহ্বান জানানো হয়। একটি আনুপাতিক ব্যবস্থা চালুর জন্য কয়েকটি অঙ্গরাজ্য কিছু ব্যবস্থা নেওয়ার প্রস্তাব করলেও কোনওটিই কার্যকর হয়নি।

সূত্র: দ্য ইন্ডিপেনডেন্ট, বিবিসি, আল জাজিরা, উইকিপিডিয়া।

#খবরের লিংকঃ বাংলাট্রিবিউন।

No comments

Featured post

একনায়িকাতন্ত্র

আমার বুকের ভেতরের "মন" নামক রাষ্ট্রে ভালোবাসার অজুহাতে যে স্বৈরাচারী শাসন ব্যবস্থা চলছে, তার নাম একনায়িকাতন্ত্র। নায়িকার ইচ্ছেমতো...

Powered by Blogger.