সেলফি সাতকাহন

সেলফি কাকে বলে, তা নিশ্চয়য়ই নতুন করে বলতে হবে না। নিজের প্রতিকৃতিকে ইংরেজিতে সেলফি বলে। কিন্তু ‌’সেলফি’ শব্দটা অনেক আগেই ছিনতাই করে নিয়ে গেছে স্মার্টফোন। নিজের ছবি নিজে তোলার নামই এখন ‌’সেলফি’। ইদানিং বাংলায় একে কেউ কেউ আবার ‘নিজস্বী’ বলতে শুরু করে দিয়েছে।
গত বছর অক্সফোর্ড অভিধানের বর্ষসেরা শব্দ ছিল সেলফি। অক্সফোর্ড অভিধানে ‘সেলফি’ মানে বলা হয়েছে, একটি আলোকচিত্র যা নিজেরই তোলা নিজের প্রতিকৃতি, সাধারণত স্মার্টফোন বা ওয়েব ক্যামে ধারণ করা এবং তা যে কোনো সামাজিক মাধ্যমে আপলোড করা হয়। অক্সফোর্ড অভিধানের বলা হয়েছে, ২০০২ সালে একটি অনলাইন ফোরাম প্রথম সেলফি শব্দটি ব্যবহার করেছিল। সেই শব্দটিই এখন দেশ কাল পেরিয়ে ফিরছে লোকে মুখে মুখে।
যুগটাই এখন সেলফির। স্মার্টফোনের সেলফি তোলার ঝড়ে হয়ত কয়েকবছর পর ক্যামেরা যাবে জাদুঘরে। সেলফির এই জনপ্রিয়তা লুফে নিয়েছে স্মার্টফোন প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানগুলো। নিত্যনতুন চমৎকার সব ক্যামেরা সেন্সর ব্যবহারের মাধ্যমে নিজেদের ডিভাইসগুলো বিক্রি বাড়িয়ে মুনাফা লুটে নিচ্ছে তারা।
সেলফি থেকে ‘সেলফিটিস’
স্মার্টফোনে নিজের স্মরণীয় সময়কে ধরে রাখতে সেলফি তোলা যেতেই পারে। কিন্তু এটা যদি মাত্রাতিরিক্ত হয়ে যায়, তাহলে দেখা দিতে পারে সমস্যা। অতিরিক্ত সেলফি তোলার অভ্যাসের বিরুদ্ধে সতর্ক করেছে মার্কিন গবেষকেরা। আমেরিকান সাইক্রিয়াটিক অ্যাসোসিয়েশন (এপিএ) সেলফি তোলার অভ্যাসটা একপর্যায়ে মানসিক ব্যধিতে রূপান্তরিত হতে পারে বলে দাবি করেছেন। বার বার নিজের ছবি তোলার প্রবণতা এবং সেই ছবি সামাজিক যোগাযোগের ওয়েবসাইটে দেওয়ার এই মানসিক সমস্যার নাম দেয়া হয়েছে ‘সেলফিটিস’।
এই মানসিক রোগটি এমনই যে, বার বার নিজের মুখটি দেখতে ইচ্ছে করে। নানাভাবে নানা কায়দায় নিজেকে দেখার এই প্রবণতা স্বাভাবিক জীবন যাপনকে এলোমেলো করে দিতে পারে। আশেপাশের মানুষের কাছে হতে মহাবিরক্তিকর চরিত্র। সুতরাং সেলফি থেকে যেন ‘সেলফিটিস’ না হয় সে ব্যাপারে নজর রাখতে হবে সবার আগে।
সেলফি যখন উন্মাদনা
এই সময়রে ছেলেমেয়েদের মধ্যে সেলফি তোলার প্রবণতা এতো বেড়ে গেছে যে, তাদের সেলফি জেনারেশন বললেও ভুল হবে না। এই সেলফি ক্রেজ দিন দিন বাড়ছেই। ছুটে আসা ট্রেন কিংবা বিষধর সাপের সামনে গিয়েও সেলফি তুলতে চান অনেকে। আর এমন বেপরোয়া আচরণের কারণে ঘটেছে জীবন হারানোর ঘটনাও।
ওয়াশিংটন পোস্টের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১৫ সালে সারা বিশ্বে সেলফি তুলতে গিয়ে কমপক্ষে ৩৭টি মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। বিল্ডিঙের ছাদের কোনায় গিয়ে ছবি তোলা বা পাহাড়ের বিপদজনক অংশে গিয়ে ‘আমি কি হনুরে’ টাইপ সেলফি তুলতে গিয়ে নিজের বিপদ টেনে আনার কোন মানেই নেই। কাজেই নিজের জীবন বিপন্ন কিংবা অন্যের ক্ষতি করে সেলফি উন্মাদনায় মেতে ওঠলে মোটেও চলবে না।
সেলফি তোলায় সচেতনতা
অনেক ঠোঁট ওল্টাচ্ছেন, সেলফি তোলায় সচেতনতা আবার কী! আসলে সেলফি তোলার সময় আমাদের অবশ্যই মাথায় রাখা উচিত কোথায় ছবিটি তুলছি। নিজের জীবনকে নিশ্চয়ই আপনি ভালোবাসেন, তাই জীবন বিপন্ন করে ছবি তোলার প্রসঙ্গ এখানে বাদই দেওয়া হলো। কিন্তু আমরা অনেক সময়ই এমন সব স্থানে ছবি তুলি যে জায়গাগুলো হয়তো হিস্টোরিকাল ট্র্যাজিক লোকেশন। এই ব্যাপারটিকে অনেকেই ভালো চোখে দেখেন না এবং মূলত এসব জায়গায় সেলফি তোলাও উচিত নয়। আবার, অনেক সময় আমরা এমন স্থানে সেলফি তুলতে চাই যেখানে হয়তো ছবি তোলার অনুমতি নেই। কাজেই বুঝে শুনে ছবি তুলবেন।
ভারতের মুম্বাই শহর ও সমুদ্র উপকূলের ১৫ স্থানে সেলফি তোলা নিষিদ্ধ করেছে দেশটির পুলিশ। শুধু তাই নয়, এসব স্থানে ভুল করেও কেউ সেলফি তুললে তাকে এক হাজার ২০০ রুপি জরিমানা দিতে হবে। নিষিদ্ধ ঘোষণা করা ওই ১৫ স্থানে নো সেলফি জোন লেখা সতর্কতা জারি করে বিলবোর্ড দেওয়া হয়েছে পুলিশের পক্ষ থেকে। যেসব স্থানে সেলফি তোলা নিষিদ্ধ করা হয়েছে সেগুলোর মধ্যে মুম্বাইয়ের মেরিন ড্রাইভ, বান্দ্রা সমুদ্রসৈকতের বাসস্ট্যান্ড ও গিরুয়াম চোপাত্তি সৈকত উল্লেখযোগ্য। কে জানে আমাদের দেশেও অদূর ভবিষ্যতে এমনটা হতে পারে, নিষিদ্ধ স্থানে সেলফি তোলার জন্য গুনতে হতে পারে জরিমানা। তাই আগেভাগেই সচেতন থাকাটাই তো ভালো।
আমরা অনেকেই সেলফি তোলার সময় এতই নিমগ্ন হয়ে যাই যে বিষয়টিতে অন্য কারও অসুবিধা হতে পারে সেদিকে কোন খেয়ালই থাকে না। এটা করা কী ঠিক? নিশ্চয়ই নয়। ধরুন একটা নতুন স্থানে আপনি আপনার পরিবারের সাথে কিম্বা বন্ধু বান্ধবের সাথে ঘুরতে গিয়েছেন। এখন আপনি যদি আপনার পারফেক্ট ছবি তোলার জন্য সারাক্ষণ ছবিই তুলতে থাকে, তাহলে তো মুশকিল তাইনা?
আপনি নিজে তো নতুন সেই স্থানটির উপভোগ্য সব কিছু থেকেই নিজেকে বঞ্চিত করবেন, পাশাপাশি আপনার সাথের মানুষগুলোও বিরক্ত হবে। আপনি নিশ্চয়ই বিরক্তিকর প্রাণীর খেতাব পেতে চান না।তাই কোন স্থানে ঘুরতে গেলে দু-একটি ছবি তুলেই ক্ষান্ত দিন। ঘুরে দেখুন চারপাশ, সেলফিই সব কিছু নয়।
সেলফি তুলুন নিখুতভাবে
এতোক্ষণে অনেকেই বোধ হয় ভাবতে শুরু করেছেন, সেলফি তোলার বিরুদ্ধেই এই লেখা। মোটেও তা নয়। প্রযুক্তি অবশ্যই আমাদের ধারণ করতে হবে, প্রযুক্তি সঙ্গে নিয়েই এগিয়ে যেতে হবে। তবে প্রযুক্তির উপর অতিরিক্ত নির্ভরতা কখনো কখনো বিপত্তি ডেকে আনে, সেলফির ব্যাপারটাও তাই।
অবশ্যই আপনি সেলফি তুলবেন, কারণ সময়কে ধরে রাখতে এর জুড়ি নেই। তবে তা তুলতে হবে নিজের নিরাপত্তা ঠিক রেখে, অন্যের বিরক্তির কারণ না হয়ে। জীবনের জন্য সেলফি, সেলফির জন্য জীবন নয়; এটা সবসময় মনে রাখতে হবে। আসুন এবার সুন্দরভাবে নিখুঁত সেলফি তোলার কিছু উপায় জানা যাক।
একটি ভালো সেলফি আপনাকে ফুটিয়ে তুলবে সবার মাঝে। আর তাই আকর্ষনীয় সেলফি তোলার ক্ষেত্রে বেশ কিছু বিষয় মেনে চলতে হয়।
সেলফি তোলার সময় আলোর বিষয়ে সচেতন থাকতে হবে। কারণ, সেলফির গুণগত মান ঠিক রাখতে আলোর ঔজ্জ্বলতা একটি বিবেচ্য বিষয়। নইতো ফ্লাশের ঝলকানির মতো চেহারাও ঝলসে যাবে। খেয়াল রাখবনে, সেলফি তোলার সময় হাত যেন না কাঁপে।
সেলফিতে অনেকের মুখের নিচের অংশ বেশ ভারী আসে। আবার অনেকের মুখে বেশি বেশি ভাঁজ দেখা যায়। এই সমস্যা দূর করতে ক্যামেরা কখনোই মুখের নীচে ধরবেন না। অ্যাঙ্গেল ঠিক করে নেওয়াটাও সঠিক সেলফির একটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ।
সেলফি তোলার সময় হাসির ক্ষেত্রেও আপনাকে একটুখানি সংযত হতে হবে। যেহেতু কাছ থেকে ছবি তোলা হয় তাই হালকা হাসিই সেলফিতে বেশি ভালো দেখায়। এমন ভাবে হাসুন যেন জিহ্বা দেখা না যায়। তাহলে হাসিটা স্বাভাবিক ও ন্যাচারাল আসবে।
অনেক সময় সেলফিতে চোখের মনি সাদা আসে। এই সমস্যা থেকে রেহাই পেতে ছবি তোলার ঠিক আগে একটু উজ্জ্বল আলোতে তাকিয়ে নিন। তাহলে চোখের পিউপিল সঙ্কুচিত হয়ে আসবে, যার ফলে মণি সাদা হওয়ার সমস্যা আর থাকবে না।
কোন অ্যাঙ্গেলে দাঁড়ালে সেলফি বেশি ভালো আসে সেটা বুঝে নিন। মুখের কোন দিকটা ছবিতে বেশি ভালো আসে সে দিকে লক্ষ রাখুন। হাত কাঁপা রুখতে এবং যে কোনো অ্যাঙ্গেলে ছবি তুলতে সেলফি স্টিক ব্যবহার করতে পারেন।
আপনার যে সেলফিটি সবচেয়ে সুন্দর এসেছে, তাতে কীভাবে দাঁড়িয়েছিলেন, মুখভঙ্গি কেমন ছিলো, সেসবই ভালো করে দেখুন এবং সেভাবে ছবি তুলুন। আর সেলফি যেহেতু খুব কাছ থেকে ছবি তুলছেন, সুতরাং খেয়াল রাখবেন মেকআপে যেন বাহুল্য না থাকে। সেটা আরো গভীরভাবে ফুটে উঠবে ছবিতে। চেষ্টা করুন হালকা মেকআপে নিজেকে সাজাতে।
কয়েকজন মিলে সেলফি তুলতে গেলে চেষ্টা করুন সবাই একই ধরনের এক্সপ্রেশন দিতে। তাহলেই ছবিটা বেশ প্রাণবন্ত দেখাবে। তবে সেক্ষেত্রে ঠিকঠাক ফ্রেমিংটাও সবচেয়ে বেশি জরুরি।
ছবিটি ভালো আসেনি, এজন্য মনখারাপের কোনো মানে হয় না। কারণ সম্পাদনা (এডিট) করার জন্য অসংখ্য অ্যাপ রয়েছে। এসব অ্যাপ ব্যবহার করে একটি বাজে ছবিকেও ঠিকঠাক করে ফেলা যায়। আপনি নিজেই একটু ঘাটাঘাটি করলে্ই তা শিখে নিতে পারেন।বিভিন্ন এডিটিং অ্যাপের সাহায্যে ছবিতে চোখের লাল ভাব দূর করুন ও কালার টোন বদলে দেখুন ছবিটাই বদলে গেছে।

No comments

Featured post

একনায়িকাতন্ত্র

আমার বুকের ভেতরের "মন" নামক রাষ্ট্রে ভালোবাসার অজুহাতে যে স্বৈরাচারী শাসন ব্যবস্থা চলছে, তার নাম একনায়িকাতন্ত্র। নায়িকার ইচ্ছেমতো...

Powered by Blogger.