আমার দিন: অভ্যাস ৫ ॥ অন্যকে বুঝুন, তারপর বোঝান
ড. স্টিফেন কোভে-এর লেখা ‘দি সেভেন হ্যাবিটস অফ হাইলি ইফেক্টিভ পিপল’ বইটিতে যে সাতটি অভ্যাসের কথা বলা হয়েছে, আজকের অভ্যাসটি তার ভেতর সবচে’ কঠিন। আমরা কথা বলছিলাম একজন মানুষ সামাজিকভাবে সফল হতে হলে কি ধরনের গুণ বা অভ্যাস থাকতে হবে। সেখানে মূলত তিনটি অভ্যাসের কথা বলা হয়েছে। সেই অভ্যাসগুলোর ভেতর প্রথমটি ছিল ‘উইন/উইন মানসিকতা’, যা আমরা কিছুদিন আগে আলোচনা করেছিলাম।
আজকে আলোচনা করছি সেই ধারার দ্বিতীয় অভ্যাসটি নিয়ে (যা মোট সাতটি অভ্যাসের পঞ্চম)। শিরোনামটি একটু বিদঘুটে, তবে বিষয়টি সোজা। কিন্তু এর বাস্তবায়ন সবচে’ কঠিন। আমরা বলে থাকি, মানুষ অভ্যাসের দাস। আসলেই তাই। কিন্তু এই অভ্যাসটি আয়ত্তে আনতে আপনাকে অনেক বেশি কাঠ-খড় পোড়াতে হবে।
পাঠকদের জন্য এটুকু বলে রাখি, আমি নিজেও কিন্তু এর কোনোও কিছুই পারি না। কেউ যেন ভেবে না বসেন, এসবের সবগুলো আমি আয়ত্তে আনতে পেরেছি। লেখকদের নিয়ে সমাজের মানুষের সোজাসাপ্টা কথা হলো, যেটা লিখছেন সেটা নিজে আগে করে দেখান। কিন্তু একজন কোচ খুব ভালো খেলোয়াড় নাও হতে পারেন। তিনি টেকনিকটা জানেন, কিন্তু প্রয়োগ করার জন্য যে কষ্টটুকু করতে হয়, সেটা হয়তো করতে চান না। তাই বলে থিউরিটা কিন্তু মিথ্যা নয়।
আজকে যে অভ্যাসটি নিয়ে লিখছি, সেটা এক পর্বে শেষ করা যাবে না। ছাপার কাগজের সীমাবদ্ধতা আছে। আমি এমনিতেই অনেক বেশি জায়গা নিয়ে ফেলছি। পত্রিকা কর্তৃপক্ষকে সেজন্য বিশেষ ধন্যবাদ। এবারে মূল বিষয়ে আসা যাক।
দুই.
এই পৃথিবীর সবচে’ কঠিন কাজটি হলো ‘কমিউনিকেশন’ বা ‘যোগাযোগ’। আমরা যখন কোথাও চাকরির জন্য মানুষ খুঁজি, সেখানে একটি বিষয় উল্লেখ থাকে, প্রার্থীর ভালো কমিউনিকেশন স্কিল বা দক্ষতা থাকতে হবে। অর্থাৎ আপনি যা অনুভব করছেন, সেটাকে সঠিকভাবে অন্যকে বুঝাতে পারার ক্ষমতা থাকতে হবে।
আমাদের মতো দেশে কমিউনিকেশন দক্ষতা নিয়ে ততোটা লেখাপড়া করানো হয় না। কিংবা আমরা ততোটা জোর দেই না। বিশেষ করে কারিগরি বিষয়ে যারা লেখাপড়া করেন (ডাক্তার, প্রকৌশলী ইত্যাদি) তাদের কমিউনিকেশন দক্ষতার উপর মোটেও জোর দেওয়া হয় না; অথচ তাদের জন্য এটা খুবই প্রয়োজনীয় একটি বিষয়। আপনার মাথায় আছে একটা ছবি, আর মানুষকে বুঝাতে গিয়ে বললেন আরেকটা ছবি, এর ফলাফল কী হবে? মানুষ তো আর অন্তর্যামী নয় যে, সে আপনার ব্রেইন থেকে গিয়ে পড়ে আসবে। আপনি যা বোঝাতে চাইবেন, সে আসলে সেখান থেকেই কিছু জিনিস বুঝে নিবে।
বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, আমাদের যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে যতগুলো মাধ্যম রয়েছে তার ভেতর টেক্সট (লেখার মাধ্যমে) মাত্র শতকতা ১০ ভাগ সঠিকভাবে বোঝানো যায়। অর্থাৎ এই যে আমি লিখছি, এটার মাত্র ১০ ভাগ একজন পাঠক বুঝতে পারছেন। বাকিটুকু হারিয়ে যাচ্ছে। এখন এই আমি যদি আপনার সাথে ফোনে কথা বলতাম, তাহলে সেটা হতো ৩০ ভাগে। অর্থাৎ ভয়েস কমিউনিকেশন শতকরা ৩০ ভাগ ইফেক্টিভ। সেখানে আপনি অপরপক্ষের গলার টোনের উঠানামা শুনতে পান, তার ইমোশনাল যে সিগনালগুলো আছে সেটাকে আপনার কান বিবেচনায় নিতে পারে।
তবে সবচে’ ভালো যোগাযোগ মাধ্যম হলো বডি ল্যাংগুয়েজ। আপনি শতকরা ৬০ ভাগ ইফেক্টিভ কমিউনিকেশন করতে পারেন সামনা-সামনি, নয়তো ভিডিও কমিউনিকেশনে। মানুষের শরীরের অঙ্গভঙ্গি অনেক কিছু বলে দেয় যা টেক্সট বা অডিও সেটাকে ধারণ করতে পারে না। এই কারণে সারা পৃথিবীতে রেডিও-এর চেয়ে টিভি অনেক বেশি জনপ্রিয় কিংবা অনেক বেশি ভালো যোগাযোগের মাধ্যম। আপনি যদি আমার এই লেখাটি না পড়ে, আমার কোনোও লেকচারে অংশ নেন, সেটা অনেক বেশি ইফেক্টিভ হবে এটাই স্বাভাবিক। মুখোমুখি যোগাযোগ ব্যবস্থায় আপনার গলার স্বর, শরীরের ভাষা সবকিছু চোখ/কান ক্যাপচার করে আপনার ব্রেইনকে দিতে পারে; আপনার ব্রেইন সেগুলো প্রসেস করে আপনাকে যা বোঝায়, আপনি তাই বোঝেন। একবার চিন্তা করুন তো- ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ যারা সামনে থেকে ওই ভাষণ শুনেছেন তাদের অনুভূতি, আর আমরা যারা এখন টিভি কিংবা ইন্টারনেটে দেখি তার অনুভূতির পার্থক্য কতটুকু?
মানুষ প্রতিনিয়ত তার চারপাশের মানুষের সাথে যোগাযোগ করছে। আপনি হেঁটে যাচ্ছেন, কারো সাথে কোনোও কথা বলছেন না- কিন্তু এই হেঁটে যাওয়ার ভেতর দিয়েও কিন্তু আপনি অন্যদের সাথে যোগাযোগ করছেন। অন্যরা আপনাকে পড়ছে। মানুষ আপনাকে নিত্যদিন, প্রতিমুহূর্তে পড়ছে। আপনি চারপাশে যে সিগনাল দিচ্ছেন, সেই সিগনালগুলো পড়ছে। আপনি ভাবতে পারেন, আমি এগুলো কেয়ার করি না, আমি আমার মতো থাকি, তাতে আমার কী! আমরা আসলে কেউ একা একা বাঁচি না। আমরা কোথাও কাজ করি, বাজার করি, কেনাকাটা করি, কারো তৈরি খাবার খাই, অন্য মানুষের কাছ থেকে সাহায্য নেই, চিকিৎসা নেই, অন্যের বানানো সফটওয়্যার ব্যবহার করি ইত্যাদি নানানভাবে আমরা আসলে সামাজিকভাবে বাঁচি। আর যারা এটা পারেন না, তারা একটা সমাজবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন, তাদের জীবন মোটেও ইফেক্টিভ হয় না।
আপনি যদি ইফেক্টিভ হতে চান, তাহলে আপনার ভালো যোগাযোগ দক্ষতা তৈরি করতে হবে। আপনি যদি অন্য মানুষকে সাহায্য করতে চান, তাহলে আপনাকে বিশেষ যোগাযোগ দক্ষতা অর্জন করতে হবে। আপনি যদি আপনার সন্তানদেরকে সঠিকভাবে গাইড করতে চান, আপনার যোগাযোগ করার ক্ষমতা বাড়াতে হবে। আর এই যোগাযোগ করার ক্ষমতা বাড়ানোর একটি বড় উপায় হলো, কাউকে নিজের কিছু বুঝাতে যাওয়ার আগে সেই মানুষটিকে বুঝতে পারা। অর্থাৎ আগে সেই মানুষটিকে বুঝুন, তারপর আপনার বিষয়টি বোঝান। আর কাউকে বুঝতে গেলে আপনার ভেতর যে অভ্যাসটি তৈরি করতে হবে তাহলো ‘হৃদয় দিয়ে শোনা’। আমরা এই বিষয়টি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব। সেটা করার আগে, চলুন দেখে নেই বিষয়টি আমাদের ভেতর কীভাবে কাজ করে।
তিন.
আপনার চোখের সমস্যা নিয়ে একজন চক্ষু ডাক্তারের কাছে গেলেন। তিনি মোটামুটি একটু দেখে তার নিজের পড়া চশমাটা আপনাকে দিয়ে বললেন, এটা চোখে লাগাও তো।
আপনি সেই চশমাটা চোখে দিয়ে বললেন, কিছুই তো দেখি না, সব ঝাপসা লাগে।
ডাক্তার আপনার পরিচিত। তিনি বললেন, কী বলছ। এই চশমা দিয়ে আমি গত দশ বছর ধরে দেখছি। একদম কাজ করে। তুমি ভালো করে চেষ্টা করো।
আপনি একটু ভ্রু বাঁকা করলেন। ডাক্তারের মুখের উপর তেমন কিছু বলা যায় না। আপনি ভদ্রতা করে বললেন, আমি চেষ্টা করছি। কিন্তু অবস্থা আগের চেয়ে খারাপ। আমার পুরনো চশমাই ভালো ছিল। এটা আরও খারাপ করে দিচ্ছে।
আপনার কথায় ডাক্তার বিরক্ত হলেন। তিনি একটু ধমকের সুরে বললেন, এত দামি একটা গ্লাস দিলাম তাও তুমি প্রশংসা করছ না! তুমি একটু ইতিবাচকভাবে দেখার চেষ্টা করো। পরিষ্কার দেখতে পাবে।
আপনিও আরও বিরক্ত হলেন। বললেন, আমি দেখতে পাচ্ছি না তো। সব ঝাপসা লাগছে।
ডাক্তারের আরও রোগী আছে। আপনাকে সময় দেওয়ার মতো আর সময় নেই। প্রেসক্রিপশন লিখে দিয়ে বললেন, তুমি বাসায় গিয়ে কিছুদিন চেষ্টা করো। তারপর দশ দিন পরে আবার আসো। দেখো, এর ভেতর কী হয়।
আপনি বুঝতে পারলেন, ডাক্তার আপনার সমস্যাটি ভালো করে না দেখেই প্রেসক্রিপশন দিয়ে দিয়েছে। আপনি কি আর সেই ডাক্তারের কাছে যাবেন? কাউকে যাওয়ার কথা বলবেন?
চার.
আপনার ছেলেটা প্রতিদিন মন খারাপ করে থাকে। এটা দেখতে কোন মা-বাবার ভালো লাগে! বাবা তার বাইরের কাজ নিয়ে ব্যস্ত। মা ঘর সামলান। তিনি ছোট ছেলের এমন মন খারাপ অবস্থা দেখে একদিন বিষয়টা নিয়ে কথা বলার চেষ্টা করলেন।
মা বললেন, সোনা কী হয়েছে তোমার? এমন মন খারাপ করে থাকো কেন আজকাল?
ছেলের উত্তর, তেমন কিছু না মা।
- কিছু একটা তো বটেই। বলো না আমাকে?
- বললাম তো কিছু হয়নি।
- তাহলে কি কেউ এমনি এমনি মন খারাপ করে থাকে?
- তেমন কিছু না। ঠিক হয়ে যাবে।
- আমি তোমার মা। আমার কাছে লুকালে আর কার কাছে বলবে তুমি?
- বিষয়টা তোমার ভালো লাগবে না, মা।
- সবকিছু আমার ভালো লাগতে হবে না। আমি তোমার ভালো চাই। তোমার ভালো হলেই আমি খুশি। তোমার বাবাও খুশি।
- আমি শিওর না।
- কি শিওর না?
- এই যে বললে, আমার ভালোতেই তোমরা খুশি।
- তোমার বিশ্বাস হচ্ছে না? তোমার বাবা এই যে দিনরাত খেটে মরছে, আমি এই যে দিনরাত সংসারটার পেছনে জীবন দিচ্ছি, কার জন্য বলো? তোমার মঙ্গলই আমরা চাই।
- কী জানি?
- আচ্ছা, তুমি বলেই দেখো না। না বললে বুঝব কীভাবে? আমরা সত্যি তোমাকে সাহায্য করতে চাই। বলো সোনা মানিক।
- ওকে মা। সত্যি কথা কি জানো?
- কি?
- আমার আর স্কুল ভালো লাগছে না।
- হোয়াট! বলো কি তুমি?
- হুম মা। আমি স্কুল একদমই এনজয় করছি না।
- তুমি কি পাগল হয়ে গেলে নাকি? তুমি জানো তোমার এই স্কুলের জন্য আমাদেরকে কত জায়গায় দৌড়-ঝাঁপ করতে হয়েছে? কত টাকা ডোনেশন দিতে হয়েছে? তোমার লেখাপড়ার জন্য তোমার বাবাকে বাড়তি কষ্ট করতে হচ্ছে। লেখাপড়া হলো তোমার জীবনের ভবিষ্যৎ। এটা হলো তোমার জীবনের উপরে ওঠার সিঁড়ি। এটাই হলো একমাত্র ভিত্তি। আর তুমি কি না বলছ, লেখাপড়া ভালো লাগছে না। তুমি এমন অকৃতজ্ঞ হয়ে গেলে কীভাবে? আমাদের এই কষ্টটুকুর কোনোও মূল্য নেই? তুমি কি রিকশা চালিয়ে জীবন চালাবে? নাকি চুরি-ডাকাতি করবে? আমি একটি চাকরি করতে চেয়েছিলাম। তোমার অসুবিধা হবে বলে সেটাও করলাম না। এগুলো তোমার চোখে পড়ে না। তুমি আছো বন্ধুদের সাথে পার্টি আর ফান নিয়ে। কথায় কথায় বোরড হয়ে যাও। তোমাকে টিভি, পিএস-ফোর, ইন্টারনেট, ল্যাপটপ কী দেওয়া হয় নাই। তবুও তুমি বলছ লেখাপড়া ভালো লাগছে না। স্কুল ভালো লাগছে না। কতবার বলেছি, তোমার ব্রেইন ভালো, একটু মোনযোগ দাও। সেটা করছ না। এটা শোনার আগে আমার মরণ হওয়া ভালো ছিল।
লম্বা একটা লেকচার দিয়ে মা থামলেন। পুরো ঘর চুপচাপ। সুই পরলে টের পাওয়া যাবে।
একটু পরে ছেলেটি আস্তে করে বলল, আমি বলেছিলাম তুমি বুঝবে না।
মা ছেলের চলে যাওয়া দেখলেন।
এমন ঘটনা কি প্রতিটি ঘরেই ঘটছে না? আমরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অসুখটা কী সেটা না বুঝেই ঔষুধ দিয়ে ফেলি। আমরা কারো ভালো চাই বলেই হয়তো সেটা করি। কিন্তু যাকে ঔষুধ দিচ্ছি, তার সমস্যাটা আগে বুঝতে পারলে ঔষুধ সেভাবে দিলে কাজে লাগতে পারে। মানুষের সাথে সম্পর্কের ক্ষেত্রে প্রথম যে শর্ত তাহলো, প্রথমেই তাকে বোঝার চেষ্টা করা, তারপর সে আপনাকে বুঝবে। ইফেক্টিভ ইন্টারপারসোনাল কমিউনিকেশনের এটাই হলো মূল নীতি।
পাঁচ.
আপনি এই মুহূর্তে আমার এই লেখাটা পড়ছেন। পড়া এবং লেখা- দুটোই কমিউনিকেশনের একটি অংশ। একইভাবে বলা এবং শোনা- এই দুটিও কমিউনিকেশনের অংশ। এই চারটি মাধ্যমকে কমিউনিকেশনের মূল মাধ্যম বলা যেতে পারে। এবারে একটু চিন্তা করুন তো, এই চারটি মাধ্যম শিখতে কোথায় আপনি কতটা সময় ব্যয় করেছেন?
‘যোগাযোগ’ হলো যেকোনোও মানুষের জন্য সবচে’ গুরুত্বপূর্ণ একটি দক্ষতা। আমরা যতক্ষণ জেগে থাকি, তার বেশিরভাগ সময়টাই আমরা ব্যয় করি কোনোও না কোনো যোগাযোগ করে। আপনি হাঁটছেন, কাজ করছেন, অফিসে যাচ্ছেন, মিটিং যাচ্ছেন, রান্না ঘর সামলাচ্ছেন- আপনি কারো না কারো সাথে কথা বলছেন; অর্থাৎ যোগাযোগ করছেন, নিজেকে প্রকাশ করছেন। জীবনের কতটা বছর পার করেছেন লিখতে এবং পড়তে? মনে আছে সেটা? সেই স্কুল জীবন থেকে শুরু করে কতগুলো বছর পার করলেন? আর কথা বলা শেখার জন্য কতটা সময়? অনেকে এখনও কথা কীভাবে বলতে হয়, সেটা ট্রেনিং নিয়ে থাকে। এখনও শিখছে। কিন্তু কখনও কি ‘শোনা’-র জন্য সময় ব্যয় করেছেন? ট্রেনিং নিয়েছেন?
কাউকে বুঝতে হলে শুনতে হবে। হৃদয় দিয়ে শুনতে হবে। কিন্তু আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় শোনার জন্য কোনোও কোর্স নেই, সময় নেই। আমরা ধরেই নিয়েছি, কান আছে আপনি শুনবেন। কিন্তু একইভাবে যদি ধরে নিতাম, আপনার মুখ আছে আপনি কথা বলতে শিখে যাবেন- সেটা কি করেছি? নাকি বছরের পর বছর ধরে কথা বলা শিখেছি? বছরের পর বছর ধরে লিখতে শিখেছি, পড়তে শিখেছি (যদিও আমাদের হাত এবং চোখ ছিলই)। ওগুলো শেখার জন্য ট্রেনিং নিয়েছি। কিন্তু ‘শোনা’-র জন্য কোনোও ট্রেনিং আমরা নিই না। যে কারণে আমরা কাউকে ততোটা বুঝতে পারি না।
ধরুন, আপনি আমাকে কিছু একটি বিষয়ে প্রভাবিত করতে চান। আপনি অর্থাৎ আপনার স্ত্রী, ছেলেমেয়েরা, আপনার প্রতিবেশী, আপনার বস, আপনার সহকর্মী, আপনার বন্ধু- সে যেই হোক, যদি আপনাকে প্রভাবিত করতে চায়, তাদেরকে আগে আপনার কথা মন দিয়ে শুনতে হবে। আমাকে প্রভাবিত করতে চাইলে, আমার কথা মন দিয়ে শুনতে হবে। আমাকে বুঝতে হবে। আর সেটা করতে হবে সততার সাথে। অর্থাৎ আমি যদি বুঝতে পারি আপনি কোনোও ভনিতা করছেন, কিংবা কোনোও চালাকি করছেন, তখন আমি সেটা ধরতে পারব এবং আপনাকে আমি গ্রহণ করব না। ফলে আপনি যতই আমার কথা কান দিয়ে শোনেন না কেন, আপনি আমাকে যতই বুঝতে শিখেন না কেন, আমি আপনার কথা শুনব না; কিংবা আপনার পরামর্শ আমি নিব না।
মূল বিষয়টা হলো, আমি দেখব আপনি আসলে কী! আমার সাথে আপনার আচরণটুকু কী! মানুষ আপনাকে কী বলে কিংবা কী ভাবে, তাতে আমার কিছু আসে যায় না। আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ হলো, আমার সাথে আপনি কীভাবে ব্যবহার করছেন। এটা আপনার ব্যক্তিত্বের অংশ; আপনার মূল মানুষটার অংশ। মোদ্দা কথা হলো, আপনি আমাকে যে এক্সপেরিয়েন্সটুকু দিচ্ছেন, তার উপর ভিত্তি করেই আমি আপনাকে পরিমাপ করব।
আপনার চরিত্র বা বৈশিষ্ট্য প্রতিনিয়ত আপনার শরীর থেকে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ছে। এটা অনেকটা সূর্য থেকে প্রতিনিয়ত আলো ছড়ানোর মতো বিষয়। আপনি প্রতিটি মুহূর্তে চারপাশে আপনার বৈশিষ্ট্যকে ছড়াচ্ছেন। আপনি আসলে কমিউনিকেট করছেন। এবং দীর্ঘ সময় ধরে আপনার এই বৈশিষ্ট্যের কারণে আপনার প্রতি আমার বিশ্বাস কিংবা অবিশ্বাস তৈরি হবে। আর যতক্ষণ না আপনার উপর আমার সেই বিশ্বাস জন্ম নেবে, ততোক্ষণ আমি নিজেকে আপনার কাছে খুলে ধরব না। কে জান, আপনি আমার কী ক্ষতি করে ফেলেন! মানুষের ব্রেইন এভাবেই কাজ করে।
আর যতক্ষণ না আমি আপনার কাছে নিজেকে উন্মুক্ত করছি, ততোক্ষণ আপনি যা কিছুই বলেন না কেন, আমি সেগুলো গ্রহণ করব না। আমাকে আপনি প্রভাবিত করতে পারবেন না। আপনার যদি ইফেক্টিভ কমিউনিকেশন স্কিল তৈরি করতে হয়, তাহলে আপনাকে আগে হৃদয় দিয়ে আরেকজন মানুষকে শুনতে হবে। তারপর সেখানে এক ধরনের বিশ্বাস এবং আস্থা তৈরি হবে। তখন মানুষ তার দরজা খুলে দিবে। যতক্ষণ না ওই দরজা খুলছে, আপনার সাথে তার যোগাযোগ কখনই ইফেক্টিভ হবে না। আর যখন দরজাটা খুলে যাবে, তখন ওই মানুষটার সাথে আপনার ইমোশনাল ব্যাংক একাউন্ট তৈরি হবে, যার আদান প্রদান হবে দুটি হৃদয়ের মাঝে।
ছয়.
একবার স্টিফেন কোভের কাছে একজন বাবা এসে অভিযোগ করে বললেন, ‘আমি আসলেই আমার ছেলেকে বুঝতে পারি না। ও আমার কথা একদমই শোনে না!’
স্টিফেন ভ্রু কুঁচকে জবাব দিলেন, ‘কি বললে! দাঁড়াও, তুমি এইমাত্র যা বললে আমি সেটাকে আবার বলি। তুমি তোমার সন্তানকে বুঝতে পারছ না, কারণ সে তোমার কথা ঠিকমতো শুনছে না।’
সেই বাবা জবাব দিলেন, ‘একদম ঠিক বলেছ।’
স্টিফেন বললেন, ‘দাঁড়াও, আমি আবারও চেষ্টা করি। তুমি তোমার সন্তানকে বুঝতে পারছ না, কারণ সে তোমার কথা শুনছে না! অর্থাৎ তুমি তাকে যা করতে বলছ, সেটা সে করছে না।’
সেই বাবা বিরক্ত হয়ে বললেন, ‘হুম, আমি তো বারবার এটাই বলছি তোমাকে।’
স্টিফেন তখন বললেন, ‘আমার ধারণা, কাউকে বুঝতে হলে আগে তাকে শুনতে হয়।’
বাবা উত্তর দিলেন, ‘ওহ!’ তারপর লম্বা একটি বিরতি। তারপর আবার বললেন, ‘ওহ!’ কিছুটা সময় নিয়ে বললেন, ‘সত্যিই তো! কিন্তু আমি সত্যি ওকে বুঝতে পারছি না। আমি বুঝতে পারছি কিসের ভেতর দিয়ে যাচ্ছে ও। আমিও জীবনে একই সমস্যার ভেতর দিয়ে গিয়েছি। কিন্তু আমি সত্যি বুঝতে পারছি না, কেন সে আমার কথাটা শুনছে না।’
আসলে ওই বাবার বিন্দুমাত্র ধারণা নেই, তার ছেলের ভেতর দিয়ে কী যাচ্ছে। বাবা তার নিজের জীবন দিয়ে, নিজের চশমা দিয়ে এই পৃথিবীকে দেখছে; একইভাবে তার নিজের ছেলেকেও।
এমনটাই ঘটে আমাদের বেশিরভাগ মানুষের জীবনে। আমরা আমাদের জীবন দিয়ে, আমাদের অভিজ্ঞতা দিয়ে, আমাদের সময় দিয়ে এই পৃথিবীকে দেখি; অন্যকে বোঝার চেষ্টা করি। আমরা মূলত আমাদের অটোবায়োগ্রাফি দিয়ে অন্যকে বুঝার চেষ্টা করি। আমার জীবনের চশমা দিয়ে অন্যকে বোঝার চেষ্টা করি। তাই আমার চোখে যদি থাকে রঙিন চশমা, তাহলে সবই রঙিন। আর আমার চোখে যদি থাকে সাদা-কালো গ্লাস, তাহলে সবই সাদাকালো। আমরা আমাদের সফলতা কিংবা ব্যর্থতা দিয়ে আরেকটি মানুষকে বুঝতে যাই। ফলে আমরা কখনই বুঝতে পারি না, ঠিক কী বয়ে যাচ্ছে ওই মানুষটির ভেতর।
(বাকিটুকু আগামী পর্বে)
No comments