আমার দিন: অভ্যাস ৫।। অন্যকে বুঝুন, তারপর বোঝান (পর্ব ২)

ড. স্টিফেন কোভে-এর লেখা ‘দি সেভেন হ্যাবিটস অফ হাইলি ইফেক্টিভ পিপল’ বইটিতে যে সাতটি অভ্যাসের কথা বলা হয়েছে, তার পঞ্চম অভ্যাসটিতে বলা হয়েছে, কাউকে কিছু বুঝাতে যাওয়ার আগে সেই মানুষটিকে বুঝতে পারার অভ্যাস তৈরি করা।
অন্য মানুষকে বুঝতে পারার ক্ষমতা তৈরি করা কঠিন একটি কাজ। তার জন্য প্রয়োজন হয় হৃদয় দিয়ে শোনার। যখন কেউ আপনার সঙ্গে কথা বলে, কিংবা আপনার সামনে কথা বলে তখন আমরা আসলে কতটা শুনি? শোনার অভ্যাস আমরা তেমনটা তৈরি করি না। আমরা মূলত চারটি উপায়ে শুনি। কিংবা বলতে পারেন এই চার উপায়ে আমাদের অভ্যাস তৈরি হয়ে গেছে।

প্রথমত, এমন হতে পারে যে আপনি আসলে শুনছেনই না। আপনি তাকে পুরোপুরি অবজ্ঞা করছেন। একজন যখন আপনার সঙ্গে কথা বলছে তখন আপনার মন কিংবা ব্রেইন হয়তো পড়ে আছে খেলার মাঠে, নয়তো বন্ধুদের আড্ডায়, নয়তো অন্য কোনো বিষয়ে। আপনি একটু খেয়াল করলেই দেখবেন, অনেক সময় আমরা রেজিস্ট্রার করি না, ঠিক কী বলছেন সামনের মানুষটি। এটা হলো পুরো ‘অবজ্ঞা’ অবস্থায় শোনা।
দ্বিতীয়ভাবে, শোনা হলো ‘শোনার ভান করা’ ইংরেজিতে যাকে বলা হয় প্রিটেন্ডিং। কেউ কথা বলে যাচ্ছে, আপনি একদম অবজ্ঞা না করে শোনার ভান করছেন- হুম, ও আচ্ছা, আসলেই, ও তাই নাকি... ইত্যাদি শব্দ ব্যবহার করে আপনি অপরপক্ষকে এক ধরনের অনুভূতি দেওয়ার চেষ্টা করছেন যে আপনি শুনছেন। কিন্তু আসলে আপনি শুনছেন না। আপনি অভিনয় করছেন।
তৃতীয় আরেক ধরনের শোনা হলো ‘বেছে বেছে শোনা’, অর্থ্যাৎ আপনি অংশবিশেষ শুনছেন। কোনো একটি আলোচনায় আপনি হয়তো পুরো মন দেননি কিংবা আংশিকভাবে কিছু কিছু অংশ শুনেছেন। ক্লাসে শিক্ষক পড়াচ্ছেন, আর আপনি পাশের বন্ধুর সঙ্গে কাটাকুটি খেলছেন, আর মাঝে মাঝে কিছু অংশ শুনছেন। তারপর শিক্ষক যখন আপনাকে কোনো প্রশ্ন করছে, তখন আপনি আকাশের দিকে তাকিয়ে কিছু একটা বলার চেষ্টা করছেন। কোনো সেমিনার গিয়েও আপনি এই কাজ করতে পারেন। এমনকি, অফিসের কোনো মিটিং-এ বসেও আপনি এই কাজ করতে পারেন। আপনার বাচ্চা স্কুল থেকে বাসায় ফিরে হয়তো হাজারটা কথা বলছে। আপনার সেগুলো শোনার সময় নেই। আপনি বেছে বেছে কিছু বিষয় শুনছেন।
চতুর্থ ধরনের শোনার অভ্যাসটি হলো ‘মনোযোগ দিয়ে শোনা’। আপনি সত্যি সত্যিই শোনার চেষ্টা করছেন বক্তার প্রতিটি শব্দ আপনি গ্রহণ করছেন, কোনো শব্দে কতটা জোর দিচ্ছে সেগুলো খেয়াল করছেন এবং আপনি বিষয়গুলো মাথায় নিচ্ছেন। এমনভাবে আমরা অনেক কিছুই শুনে থাকি, আমাদের কান এবং ব্রেইনকে ব্যবহার করে থাকি।
উপরের চারটি উপায়েই বেশিরভাগ মানুষ শুনে থাকে। কিন্তু স্টিফেন কোভে পঞ্চম আরেকটি শোনার কথা বলছেন, যাকে বলা যেতে ‘সহমর্মিতা নিয়ে শোনা’ (ইংরেজিতে এমপ্যাথিক লিসনিং), যা খুব কম মানুষ ব্যবহার করে।
দুই.
অনেকেই হয়তো ভাবছেন, সহমর্মিতা নিয়ে শোনার অর্থ হলো খুব মনোযোগ দিয়ে শোনা, নয়তো খুব সতর্কতার সঙ্গে শোনা কিংবা বক্তার সঙ্গে প্রতিউত্তর দিয়ে আলোচনায় অংশগ্রহণ করাকে বুঝতে পারেন। অনেক সময় আমরা বক্তার কথাকেই তার সামনে পুনরায় বলি। ধরুন কেউ বলল, আমার জ্বর হয়েছিল। আপনিও তার সঙ্গে সহমর্মিতা দেখানোর জন্য বললেন, ওহ তোমার জ্বর হয়েছিল! একটু অবাক হলেন। মূলত কারও কথায় আপনি অভিব্যক্তি দিচ্ছেন। আপনি হয়তো গলাটা খুব নরম করে বললেন, আহা, তোমার কি অনেক জ্বর ছিল?
এটা মূলত ‘উত্তর’ দেওয়ার জন্য শোনা। আপনি তাকে একটা উত্তর দিতে চান, নয়তো তাকে নিয়ন্ত্রণ করতে চান, নয়তো তার কোনো সিদ্ধান্তকে পাল্টে দিতে চান। আপনি ছোটবেলা থেকে একভাবে শুনে অভ্যস্ত। আপনার ভেতর সেই স্ক্রিপ্টটা রয়েছে। কিংবা আপনি পরবর্তীতে সেই প্রক্রিয়াটুকু রপ্ত করেছেন। তাই কেউ আপনার সঙ্গে কথা বললে আপনি সেই স্ক্রিপ্টটা চালিয়ে দেন এবং আপনি আপনার বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী শুনে যান। এছাড়া আপনি কারও সঙ্গে আলোচনায় অংশ নিয়ে আপনার নিজের সেই বৈশিষ্ট্যগুলো দিয়েই বিষয়টাকে বিচার করেন এবং উত্তর দেন কিংবা কোনো প্রতিক্রিয়া দেন।
কিন্তু স্টিফেন কোভে যেই শোনার কথা বলছেন (এমপ্যাথিক লিসনিং) সেটা ভিন্ন। আমি বাংলায় এটাকে বলার চেষ্টা করছি ‘সহমর্মিতা নিয়ে শোনা’ কিংবা ‘বুঝার জন্য শোনা’। আপনি যখন সত্যি সত্যি কোনো কিছু বুঝার জন্য শুনবেন, তখন সেই শোনাটা একদম ভিন্ন ধরনের। আপনি সত্যি সত্যি বিষয়টা আগে বুঝতে চান- এই মনোভাব নিয়ে যখন শুনবেন, তখন আপনার দুটি ব্রেইনই একসঙ্গে কাজ করবে। যুক্তি এবং ইমোশন দুটোই প্রাধান্য পাবে। সেটাই হলো ‘সহমর্মিতা নিয়ে শোনা’। আপনি মূলত বিষয়টির গভীরে যাওয়ার চেষ্টা করছেন এবং সততার সঙ্গেই চেষ্টা করছেন। কাউকে দেখানোর জন্য নয়, কোনো ভান করার জন্য নয়।
এই সহমর্মিতা নিয়ে শোনার অর্থ হলো, আপনি আরেকজন মানুষের ‘ফ্রেম অফ রেফারেন্স’-এ ঢুকে যাওয়া। মানুষটি কেন এই কথাগুলো বলছে সেই পয়েন্টটিতে চলে যাওয়া। আপনি এই পৃথিবীতে দেখতে পাবেন তাদের মতো করে, তাদের চোখ দিয়ে, তাদের হৃদয় দিয়ে। আপনি বুঝতে পারবেন ঠিক কী অবস্থায় থেকে অপরপক্ষ কথাগুলো বলছে। কেউ একজন আপনাকে বলল, কাল রাতে আমি খাইনি। এই ছোট কথাটা সে কোন অনুভূতি থেকে বলছে, সেটা বুঝতে পারার ক্ষমতা তৈরি করা। সে এটা বলতে পারে নানান দৃষ্টিভঙ্গি থেকে। তার ঘরে হয়তো খাবার ছিল না, খাবার কেনার টাকা ছিল না, নয়তো তিনি একটি ডায়েট চার্টে আছেন। দুটো ঠিক দুই মেরুর অবস্থান। আপনি যখন সহমর্মিতা দিয়ে শুনবেন, তখন এটা বুঝতে পারবেন।
তবে এখানে একটি বিষয় ভুল বুঝতে পারেন। সহমর্মিতা কিন্তু সহানুভূতি নয়। কিংবা ইংরেজি ‘এমপ্যাথি’ কিন্তু ‘সিমপ্যাথি’ নয়। আপনি কারও প্রতি সহানুভূতি দেখাচ্ছেন- সেটা কিন্তু এক ধরনের সিদ্ধান্ত কিংবা আপনার মনের অবস্থা। কেউ কান্না করছে, তার দুঃখে সহানুভূতিশীল হয়ে আপনিও কাঁদতে শুরু করে দিলেন। ওটা হলো একটা স্টেট বা অবস্থা। আপনি তার সঙ্গে একমত প্রকাশ করলেন, কিংবা একাত্ততা ঘোষণা করলেন। অনেক সময় আপনি পুরো বিষয়টি না বুঝেও কারো জন্য খারাপ কিংবা ভালোলাগা থেকে সহানুভূতি দেখাতে পারেন। এর সঙ্গে গভীরভাবে বুঝার কোনো সম্পর্ক নেই। কেউ অনশন করছে, আপনিও সঙ্গে গিয়ে অনশনে যোগ দিলেন। এটা হলো সহানুভূতি। অন্যদিকে, সহমর্মিতা হলো বিষয়টির মূলে যাওয়া, সেটাকে বুঝতে পারা। মানুষটি কেন না খেয়ে আছে, কেন অনশন করছে কিংবা কেন কাঁদছে সেটার গভীরে গিয়ে তার জায়গা থেকে বিষয়টিকে দেখা। তার চোখ এবং মন দিয়ে বিষয়টিতে দেখতে পাওয়া। কাউকে গভীরভাবে মানসিক এবং বুদ্ধিবৃত্তিক উভয়ভাবেই বুঝতে পারা।
আর এই ধরনের শোনার ক্ষমতা তৈরির জন্য শুধুমাত্র কোনো কিছুর শাব্দিক অর্থ, কিংবা কারও কথার প্রতিউত্তর, কিংবা বক্তা যা বলছেন সেটুকুকেই বিচারে নিয়ে বিশ্লেষণ করাটাই যথেষ্ঠ নয়। আপনাকে বিষয়টি বুঝার জন্য ভেতরের প্রেক্ষাপটটাও বিবেচনায় আনতে হবে। বক্তার শরীরের ভাষা পড়তে হবে, তার গলার টোন পড়তে হবে। আপনার ডান এবং বা- উভয় দিকের ব্রেইনকেই কাজে লাগাতে হবে। বিষয়টি আপনাকে অনুভব করতে হবে।
নিঃসন্দেহে এটা একটা কঠিন কাজ।
তিন.
স্টিফেন কোভের নিজের জীবনের একটি গল্প এখানে শেয়ার করা যেতে পারে। গল্পটি বলার মূল উদ্দেশ্য হলো, প্রেসক্রিপশন দেওয়ার আগে যদি সমস্যাটির ভালো করে ডায়াগনোস করানো যায় তাহলে ভালো ফলাফল পাওয়া যায়- সেটা দেখানো। আমরা যেহেতু কথা বলছি এমন একটি অভ্যাস তৈরির যেখানে বলা হচ্ছে, কাউকে কিছু বুঝাতে যাওয়ার আগে, তাকে বুঝার অভ্যাস তৈরি করা, সেখানে এই অসুখ/ডাক্তার সম্পর্কটি খুব ভালো একটি উদাহরণ বটে।
স্টিফেনের মেয়ে জেনির যখন মাত্র দুই মাস বয়স তখন সে কোনো এক শনিবারে অসুস্থ্য হয়ে পড়ে। সেদিন ছিল ছুটির দিন। এবং তাদের শহরে ফুটবল খেলা, যেখানে পুরো স্টেডিয়াম জুড়ে ৬০ হাজার দর্শক খেলা দেখতে এসেছে। স্টিফেন এবং তার স্ত্রীরও ওই খেলা দেখতে যাওয়ার কথা। কিন্তু মেয়ে অসুস্থ্য হয়ে যাওয়ার তারা খেলা দেখতে যাননি। জেনি যেভাবে বমি করছে এবং ডায়রিয়া হয়েছে তাতে করে তাকে বাসায় রেখে যাওয়াটা ঠিক মনে করেননি তারা।
ছুটির দিন। ডাক্তার সাহেবও খেলা দেখতে গিয়েছেন। তবে তিনি জেনির নিয়মিত ডাক্তার নন। তিনি জরুরি ডাক্তার হিসেবে অন-কলে ছিলেন। জরুরি কাজে তাকে ফোনে পাওয়া যাবে। জেনির অবস্থা খারাপ হতে দেখে তারা ডাক্তারকে ফোন করার সিদ্ধান্ত নেন। তার স্ত্রী স্যান্ড্রা স্টেডিয়ামে ফোন করলেন এবং ডাক্তারকে খুঁজে বের করা হলো। খেলা তখন টান-টান উত্তেজনা। স্যান্ড্রা ডাক্তারের গলার স্বর শুনে সেটা বুঝতে পারলেন।
স্যান্ড্রা ইতস্তত করে বললেন, ‘ডক্টর, আমি মিসেস কোভে বলছি। আমরা আমাদের মেয়ে জেনিকে নিয়ে দুঃচিন্তায় আছি।’
ডাক্তার জানতে চাইলেন, ‘রোগীর অবস্থা কেমন?’ স্যান্ড্রা অবস্থা বর্ণনা করলেন। সব শুনে ডাক্তার বললেন, ‘তুমি চিন্তা করো না। আমি এখুনি প্রেসক্রিপশন পাঠিয়ে দিচ্ছি। তুমি কোনো ফার্মেসী থেকে ওষুধ নিবে?’
ফোন রাখার পর স্যান্ড্রার মনে হলো, খেলার ভেতর তাড়াহুড়ো করে সব তথ্য দেওয়া হয়নি। তবে যেটুকু দেওয়া হয়েছে, সেটা হয়তো যথেষ্ট।
স্টিফেন কোভে তার স্ত্রীকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোমার কি মনে হয় ডাক্তার বুঝতে পেরেছে যে জেনি নতুন জন্ম নেওয়া একটি শিশু?’
স্যান্ড্রা উত্তরে বললেন, ‘বুঝতে পারার কথা।’
স্টিফেন প্রশ্ন করলেন, ‘কিন্তু তিনি তো আমাদের নিয়মিত ডাক্তার নন। তিনি আগে কখনো জেনিকে চিকিৎসা করেননি।’
স্যান্ড্রা বললেন, ‘আমি নিশ্চিত, তিনি এটা জানেন।’
স্টিফেন বললেন, ‘তুমি কি পুরোপুরি নিশ্চিত না হয়ে এই ওষুধ দিতে চাও?’
স্যান্ড্রা চুপ করে থাকলেন। একটু পর বললেন, ‘তাহলে আমরা এখন কী করবো?’
স্টিফেন বললেন, ‘তাকে আবার কল করো।’
স্যান্ড্রা বললেন, ‘তুমি কল করো।’
স্টিফেন কোভে নিজেই ফোনটি করলেন। ডাক্তারকে খেলার মাঠে আবারও খুঁজে বের করা হলো। এটা মূলত মাইকে ঘোষণা দিয়েই করা হয়ে থাকে। ডাক্তার এসে ফোনটি ধরলেন। স্টিফেন জিজ্ঞেস করলেন, ‘ডাক্তার, তুমি যখন ফার্মেসীতে ওষুধের কথা প্রেসক্রাইব করেছো, তখন কি তুমি খেয়াল করেছ যে জেনির বয়স মাত্র দুইমাস?’
ডাক্তার অবাক হয়ে বললেন, ‘নাহ, আমি সেটা বুঝতে পারিনি। তুমি কল করে ভালোই করেছ। আমি এখুনি ওষুধ পাল্টে দিচ্ছি।’
মূল কথা হলো, আপনার যদি রোগ নির্ণয়ের উপর বিশ্বাস না থাকে, তাহলে ওষুধের উপরেও বিশ্বাস থাকবে না। এটা জীবনের সকল ক্ষেত্রে, সকল যোগাযোগ মাধ্যমের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য।
চার.
যেহেতু আমরা আমাদের জীবনের অভিজ্ঞতা দিয়ে বিষয়গুলো শুনে থাকি এবং বিচার করে থাকি, তাই মানুষ মূলত চারভাবে রেসপন্স করে থাকে।
এক. আমরা মূল্যায়ন করি (ইভালুয়েশন)। আমরা কারও কথা শুনে তার সঙ্গে একমত হই, নয়তো দ্বিমত পোষণ করি। একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলি। আমরা অনেক সময়ই পুরোটা না শুনেই মূল্যায়ন করি।
দুই. আমরা যাচাই করি (ইংরেজিতে যাকে বলে প্রোব)। আমরা আমাদের রেফারেন্স পয়েন্ট থেকে নানান ধরনের প্রশ্ন করে বিষয়টি যাচাই করি।
তিন. আমরা উপদেশ দেই। আমরা আমাদের নিজেদের অভিজ্ঞতার আলোকে কাউকে সমবেদনা দেই, শান্ত্বনা দেই কিংবা তাকে মানসিকভাবে সাপোর্ট দেই।
চার. আমরা ইন্টারপ্রেট করি। আমরা কারও কথা থেকে তার ভেতরের অবস্থানটা বুঝার চেষ্টা করি, তাদের ব্যবহার, তাদের উদ্দেশ্য ইত্যাদি বুঝতে চেষ্টা করি। তবে সেগুলো আমাদের নিজেদের উদ্দেশ্য এবং ব্যবহারগুণের ওপর ভিত্তি করেই করি।
উপরের এই রেসপন্সগুলো আমাদের ভেতর সহজাতভাবেই চলে আসে। কারণ আমাদের ভেতর এগুলোর স্ক্রিপ্ট লেখা আছে। আমরা মূলত ওই স্ক্রিপ্টগুলো দ্বারাই পরিচালিত হই। কিন্তু একবারও কি ভেবে দেখেছেন, এই পূর্ব নির্ধারিত এই স্ক্রিপ্টগুলো অন্যকে বুঝতে আসলে আমাদেরকে কতটা সাহায্য করে?
আপনি যদি আপনার ছেলে বা মেয়ের সঙ্গে কোনো বিষয়ে কথা বলতে যান, সেই ছেলে বা মেয়েটি কি আপনার সঙ্গে খোলামনে নিজেকে প্রকাশ করতে পারছে? সে মুখ দিয়ে যা বলছে তার উপর ভিত্তি করেই আপনি যখন তাকে মূল্যায়ন করছেন, তখন কি আসলেই সে আপনাকে সবকিছু খুলে বলছে? মা-বাবা হিসেবে আপনি এই ধরনের সমস্যা যে একদম পড়েননি সেটা কিন্তু বলা যাবে না। উপরন্ত বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই হয়তো আমরা এই ধরনের সম্পর্ক স্থাপন করি। মা-বাবার সঙ্গে ছেলেমেয়েদের অনেক দূরত্ব তৈরি হয়ে থাকে। কেউ কাউকে বুঝতে পারে না। এবং আমরা ধরে নেই, এটাই স্বাভাবিক।
আর প্রতিনিয়ত যাচাই করা? অর্থ্যাৎ আপনি যে হাজারটা প্রশ্ন করছেন, তাকে প্রোব করছেন? সেটাকে সে কিভাবে নিচ্ছে? মা-বাবারা যে তাদের সন্তানদের কাছে পৌঁছাতে পারে না তার মূখ্য একটি কারণ হলো প্রতিনিয়ত ‘প্রোব’ করা। আপনি প্রতিনিয়ত তাকে যাচাই করে যাচ্ছেন - সকালে কী করেছ, স্কুলে কী করলে, বন্ধুরা কী বলল, কার সঙ্গে কী নিয়ে কথা বলেছ, ওমুকে কী বলল, স্কুল থেকে ফিরতে দেরি হলো কেন, বন্ধুদের সঙ্গে কোথায় গিয়েছিলে, কলেজের পর মার্কেটে কী, বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস শেষে এতোক্ষণ আড্ডা দেওয়ার কী আছে... ইত্যাদি হাজারও প্রশ্নে আমরা আমাদের সন্তানদের জীবনে ঢুকে যেতে চাই। প্রতিনিয়ত এই প্রোব করার ফলে, তারা নিজেদেরকে গুটিয়ে নেয়। আলোচনাগুলো অনেকটা নিচের মতো হয়-
বাবা: সুমন, সবকিছু কেমন যাচ্ছে?
ছেলে: ভালো।
বাবা: কী করলে এর ভেতর?
ছেলে: তেমন কিছু না।
বাবা: কোন জিনিসটা তোমাকে স্কুলে সবচে বেশি আনন্দ দেয়?
ছেলে: তেমন কিছু না।
বাবা: এই উইক-এন্ডে কী করবে পরিকল্পনা করেছ?
ছেলে: জানি না।
আপনি তার মুখ থেকে কথাই বের করতে পারছেন না। অথচ একটু খেয়াল করলেই দেখবেন, সারাদিন বন্ধুদের সঙ্গে ফোনে কথা বলছে, নইলে চ্যাট করছে, নয়তো টেক্সট। কই তখন তো তার আগ্রহের কমতি হচ্ছে না! আপনার বাসাটা মূলত একটা মোটেলে পরিণত হয়েছে, যেখানে সে খাচ্ছে আর ঘুমাচ্ছে, কিন্তু কিছুই শেয়ার করছে না, নিজেকে মেলে দিচ্ছে না।
আপনি যদি সত্যিকার অর্থেই বুঝতে চান, কেন করছে না- তাহলে দেখবেন অতীতে হয়তো কখনো সে নিজেকে মেলে দিয়েছিল কিন্তু তাতে তার পরিণতি ভালো হয়নি। আপনি হয়তো তাকে খুব খারাপভাবে ব্যবহার করেছেন, ধমক দিয়েছেন, নয়তো হাজারটা উপদেশ দিয়েছেন। তাহলে কেন সে আপনার কাছে নিজেকে মেলে দেবে?
আমাদের ভেতর ওই চারটি রেসপন্স এমন গভীরভাবে স্ক্রিপ্ট করা যে, আমরা বুঝতেই পারি না, সেগুলো কিভাবে আমাদেরকে পরিচালিত করছে। আমরা যখন এগুলো ব্যবহার করি, আমরা বুঝতেও পারি না কখন কোনটা ব্যবহার করে ফেলেছি। কিন্তু আমরা যদি প্রথমেই নিজেকে প্রস্তুত করি যে, আমি আগে বিষয়টি বুঝার জন্য শুনব, তারপর রেসপন্স করব - তাহলে পুরো বিষয়টিই ভিন্ন রকমের হতে পারে। এবং এই অভ্যাসটি আপনি আমার এই লেখাটা পড়ার পর থেকেই চর্চা করতে পারেন। এবং ফলাফল পেতে শুরু করবেন।
পাঁচ.
এই পাঁচ নম্বর অভ্যাসটি খুবই কার্যকরী এবং ক্ষমতাশালী। কারণ এই অভ্যাসটি আপনার সার্কেল অফ ইনফ্লুয়েন্সের ঠিক মাঝ খানটায় বসে আছে। অন্য মানুষের সঙ্গে সমস্যা, মতের অমিল, পরিস্থিতি মোকাবেলা করা, অন্য মানুষের ব্যবহার - এমন অসংখ্য বিষয় আছে যেগুলো আপনি দক্ষতার সঙ্গে সমাধান করতে চান। কিন্তু এগুলো সবই হলো আপনার জন্য সার্কেল অফ কনসার্ন, যেখানে সময় ব্যয় করাটা হবে বোকামি। আপনি এখানে সময় দিলে ফলাফল পাবেন খুবই কম। কিন্তু আমরা অভ্যাস-১, এ বলেছিলাম, আপনার সময় ব্যয় করতে হবে সার্কেল অফ ইনফ্লুয়েন্সে। তাই আপনার জন্য সবচে ইফেক্টিভ উপায় হলো এই পাঁচ নম্বর অভ্যাসটি গঠন করা।
আপনি সবসময় প্রথমেই চেষ্টা করতে পারেন, কাউকে বোঝার। এটা কিন্তু আপনার নিয়ন্ত্রণে। এর জন্য আপনাকে অন্যের উপর নির্ভর করতে হবে না। আপনি একটু চেষ্টা করলেই অন্যকে বুঝতে পারার অভ্যাসটি তৈরি করতে পারেন। আর এটা যদি হয় আপনার সার্কেল অফ ইনফ্লুয়েন্সের কেন্দ্রবিন্দু, তাহলে দেখবেন আপনি কিছুদিন পর একটি মানুষকে খুব গভীর থেকে বুঝতে পারবেন। তখন আপনার কাছে কাজ করার জন্য যাবতীয় বিস্তারিত তথ্য থাকবে। আপনি বিষয়টির মূলে চলে যেতে পারবেন। আপনার সঙ্গে সেই মানুষটির ইমোশনাল ব্যাংক একাউন্ট তৈরি হবে। এবং আপনি অন্য মানুষটিকে মানসিক স্পেস দিতে শিখে যাবেন, যার ফলে তার সঙ্গে খুব স্বাচ্ছন্দে কাজ করতে পারবেন।
এটা অনেকটা ভেতর-থেকে-বাইরে (ইনসাইড-আউট) পদ্ধতি। এবং এটা যখন আপনি প্রয়োগ করবেন, আপনি খেয়াল রাখুন আপনার সার্কেল অফ ইনফ্লুয়েন্স কিভাবে কাজ করে। এবং আপনি যেহেতু সত্যি সত্যিই শুনছেন, আপনার ইনফ্লুয়েন্স করার ক্ষমতা অনেক বেড়ে যাবে। আর তখনি আপনি অন্যকেও ইনফ্লুয়েন্স করতে পারবেন। আপনার সার্কলটি বড় হতে শুরু করবে। এমনকি যে বিষয়গুলো আপনার সার্কেল অফ কনসার্নে ছিল, দেখবেন সেগুলোকেও আপনি প্রভাবিত করতে শুরু করেছেন। এবং একই সঙ্গে খেয়াল রাখুন আপনার ভেতরে কী ধরনের পরিবর্তন আসতে শুরু করেছে। আপনি যতই মানুষকে গভীরভাবে বুঝতে শুরু করবেন, আপনি ততই তাদেরকে প্রশংসা করতে শুরু করবেন। এটা আপনি নিজ থেকেই করে ফেলবেন, যা হয়তো আপনি আগে করতেন না। আপনি তাদেরকে আরও বেশি অনুভব করতে শিখবেন। অন্য মানুষের হৃদয় জয় করা অনেকটা পবিত্র মাটির উপর দিয়ে হেটে যাওয়ার মতো একটি বিষয়।
এই অভ্যাসটি আপনি এই মুহূর্ত থেকেই শুরু করতে পারেন। আজ থেকে আপনি যার সঙ্গেই কোনো কাজ করতে যাবেন; আপনার বাড়ির মানুষ, আপনার সন্তান, আপনার অফিসের সহকর্মী, আপনার বিজনেস পার্টনার, কিংবা অন্য ব্যবসার কোনোও ব্যক্তি- আপনি প্রথমেই নিজের আত্মজীবনীর পোশাকটুকু খুলে ফেলবেন। মন দিয়ে সত্যিকার অর্থ্যেই বোঝার জন্য সেই মানুষটির কথা শুনবেন। আপনি সৎভাবেই তাকে বুঝতে চেষ্টা করবেন। এমনকি মানুষটি যদি নিজেকে আপনার সঙ্গে মেলে নাও দেয়, তবুই আপনি মহমর্মিতা দিয়ে শুনবেন। আপনি তার হৃদয়কে বুঝতে পারবেন, আপনি তার ক্ষতটা বুঝতে পারবেন। এবং তাকে আপনি বলতে পারবেন, আপনাকে আজ খুব চুপচাপ মনে হচ্ছে। সব ঠিক আছে তো?
এর জবাবে তিনি যদি কিছু নাও বলেন, তাহলেও ঠিক আছে। আপনি তো তাকে বুঝতে শুরু করেছেন এবং তাকে সম্মান দেখাচ্ছেন। তাকে চাপ দেওয়ার প্রয়োজন নেই, ধৈর্য ধরুন, তাকে সম্মান দেখান। মানুষকে সব সময় মুখ দিয়ে কথা বলে নিজেকে মেলে ধরতে চায় না। অনেক সময়, তার চোখ এবং শরীরের ভাষা দিয়ে অনেক কথা বলা যায়, যা আপনি তাকে দেখেই বুঝতে পারবেন।
এটা আপনি আপনার সন্তানদের উপরেও পরীক্ষা করে দেখতে পারেন। আপনি যদি একজন প্রোএকটিভ মানুষ হন, তাহলে আপনি সময় ব্যয় করছেন প্রভেনটিভ কাজে। অর্থ্যাৎ আপনি দেখবেন আপনার সন্তান স্কুলে কোনো সমস্যা হওয়ার আগেই আপনি সেটা টের পেয়ে যাবেন এবং সেই সমস্যাটার মুখোমুখি হতেই হবে না। আপনি আপনার সন্তানদের সঙ্গে একা একা সময় কাটান। তাদের কথাগুলো শুনুন, তাদেরকে বুঝার চেষ্টা করুন। বাসায়, স্কুলে, কিংবা বন্ধুদের সঙ্গে - কোথায় সে চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছে সেটা তাদের মুখের কথা, চোখের ভাষা থেকে পড়ার চেষ্টা করুন। তাদের সঙ্গে ইমোশনাল ব্যাংক একাউন্ট তৈরি করুন। দেখবেন, দারুন ফলাফল পাচ্ছেন।

No comments

Featured post

একনায়িকাতন্ত্র

আমার বুকের ভেতরের "মন" নামক রাষ্ট্রে ভালোবাসার অজুহাতে যে স্বৈরাচারী শাসন ব্যবস্থা চলছে, তার নাম একনায়িকাতন্ত্র। নায়িকার ইচ্ছেমতো...

Powered by Blogger.